কবিতাবলী (হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৮৭১)/প্রলয়

উইকিসংকলন থেকে
প্রলয়।[১]



ফিরে কি আসিছে প্রলয়ের কাল
নাশিতে পৃথিবী?—ফিরে কি করাল

বাজিবে বিষাণ ভীষণ নিনাদে?
জ্বলন্ত আকাশে বিপুল প্রমাদে
ফিরে কি উঠিবে দ্বাদশ রবি?


ভয়ঙ্কর কথা—ব্রহ্মাণ্ড বিনাশ
করিতে আসিছে প্রচণ্ড হুতাশ—
ভানুর মণ্ডলে তড়িতের শিখা
গিরি চুড়াকৃতি, বায়ু পথে দেখা
দিয়াছে অদ্ভুত অনল ছবি।
স্থিরবায়ু ভেদি তড়িত কিরণ
রাশি স্তূপাকার করিছে গমন
পৃথিবীর দিকে—আকৃতি ভীষণ
দেখিতে অদ্ভুত অনল ছবি।
জ্বলন্ত আকাশে বিপুল প্রমাদে
ফিরে কি উঠিবে দ্বাদশ রবি?


আসিছে অনল ব্রহ্মাণ্ড উজলি,
(দেখেছে শূন্যেতে পণ্ডিতমণ্ডলী)
জগত ব্রহ্মাণ্ড করিবে গ্রাস।

একি ভয়ঙ্কর—বিশ্ব চরাচর,
সোম, শুক্র, বুধ, মহী, শনৈশ্চর,—
বিদ্যুৎ অনলে হবে বিনাশ!

আকাশের গ্রহ, নক্ষত্র মণ্ডলী,
অনলে পুড়িয়া পড়িবে সকলি;
অখিল ব্রহ্মাণ্ড হবে শূন্যময়,
সমুদ্র, পবন, প্রাণী সমুচয়,—
এমন পৃথিবী হবে বিনাশ!


হবে কি বিনাশ এমন পৃথিবী?
অথবা যেমন চন্দ্রমার ছবি,
প্রাণীশূন্য মরু হয়ে চিরকাল,
ভ্রমিবে শূন্যেতে হিমানীর তাল—
মানব বিহঙ্গ কিছু না রবে?

না রবে জলধি, নদনদীজল,
অগাধ সাগর হবে মরুতল,
শীত গ্রীষ্ম ঋতু ফুরাবে সকল,
মানব পতঙ্গ কিছু না রবে?

না রবে মানব—বিপুল মহীতে
মানবের মুখ পাব না দেখিতে,
পাব না দেখিতে জগতের সার
রূপের প্রতিমা, সুখের আধার
রমণীর মুখ—ভবের ভূষণ
বিধাতার চারু মানস সৃজন—
চিরদিন তরে বিলীন হবে।


বিহঙ্গের স্বর, তরঙ্গ নির্ঝর,
কুসুমের আভা, ঘ্রাণ মনোহর,
বালকের হাসি, আধ আধ বোল,
ঘন ঘটাছটা, জলের কল্লোল,
চাঁদের কিরণ, তড়িতের খেলা,
ভানুর উদয়, ভূধরের মেলা,
দেখিতে শুনিতে পাব না আর।

এত যে সাধের এত যে বাসনা,
আশা, অভিলাষ, কিছুই রবে না,
আনন্দ, বিষাদ, ভাবনাকলাপ,
প্রণয়ের সুখ, প্রতাপের তাপ,

ধনের মর্য্যাদা, মানের গৌরব,
জ্ঞানের আস্বাদ, প্রেমের সৌরভ,
কিছু কি রবে না রবে না তার?


বিরলে বসিয়া এ মহীমণ্ডলে,
উজানে ভাসিয়া কালের হিল্লোলে,
আর কি পাব না সে ভাবে ভাবিতে,
আর কি পাব না সে সবে দেখিতে,
নয়নে কাঁদিয়া, স্বপনে ডুবিয়া,
মানসে ভাবিয়া পুলকে পূরিয়া,
যে সবে দেখিতে বাসনা হয়!

শিশু বাল্যকাল যৌবন সরল,
(কখন অমৃত কখন গরল)
কুটিল প্রবীণ মানবজীবন,
লহরী লুকায়ে হবে অদশন,
এ জীবপ্রবাহ—হবে প্রলয়!


এত যে সহস্র জীবের রতন—
দেবের সদৃশ মহামতিগণ

যুগে যুগে যুগে পরাণ সঁপিয়া
আকাশ, জলধি, পৃথিবী খুঁজিয়া
জ্ঞান সঞ্চারিল, মানব জাতিতে
আনন্দ নির্ঝর অজস্র করিতে,—
সকলি কি হায় বৃথায় যাবে?
তবে কি কারণ, বৃথা এ সকল
এ মানব জাতি, এ মহীমণ্ডল,
এমন তপন, তারা, শশধর,
এত সুখ দুঃখ, রূপ মনোহর—
বিধির স্বজন কেন, কি ভাবে?


নাহি কি কোনই অভিসন্ধি তার?—
জীবাত্মা, জীবন, সকলি অসার
এত যে যাতনা, যাতনাই সার—
সুধুই বিধির সাধের খেলা!
তবে ভস্মসাৎ হোক্ রে এখনি
দেহ, পরমায়ু, আকাশ, অবনী,
আঁধারে ডুবিয়া হোক্‌ ছার খার,
কিবা এ ব্রহ্মাণ্ড, জীব জন্তু আর—
চিরদিন তরে যাক্‌ এ বেলা!

এ মানব জাতি, এ মহীমণ্ডল
বৃথা এ সকল—সকলি নিস্ফল—
এই কি বিধির সাধের খেলা!

বিধাতা হে আর করো না সৃজন
এমন পৃথিবী, এমন জীবন;—
কর যদি প্রভূ ধরা পুনর্ব্বার,
মানব সৃজন করো না আর;
আর যেন, দেব, না হয় ভুগিতে
জীবাত্মার সুখ—না হয় আসিতে,
এ দেহ এ মন ধারণ করিতে,
এরূপ মহীতে কখন আর।


  1. গত বৎসর সম্পূর্ণ সূর্য্যগ্রহণকালে ইউরোপীয় পণ্ডিতেরা দেখিয়ছিলেন যে সূর্য্যমণ্ডল হইতে এক অদ্ভুত বিদ্যুতাকৃতি জ্যোতিরেখা নিৰ্গত হইয়া পৃথিবীর দিকে আসিতেছে; প্রায় অৰ্দ্ধেক পথ অতিক্রম করিয়া আসিয়াছে, এবং যেরূপে বেগে আসিতেছে তাহাতে অনতিবিলম্বে পৃথিবীকে আচ্ছন্ন করা সম্ভব। সেই উপলক্ষে ইহা বিরচিত হইয়াছিল।