পাতা:অপু-পথের পাঁচালী-অপরাজিত.pdf/৭৫৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আঁচড়াইবার যশোরের-চিরুনিখানা, তাহাতে বাবার কয়েকটা চুল এখনও জড়াইয়া আছে। ঘাড়ের কাছে ময়লা হইয়া-যাওয়া দুইটা জামা দেয়ালের পেরেক হইতে ঝুলিতেছে। এসব দেখিতে দেখিতে কাজল জানলা দিয়া বাহিরে তাকাইল । বেলা পড়িয়া আসিতেছে । সূর্যটা কেমন করুণাহীনকাহারও দুঃখের সমব্যথী নহে, সমস্ত দিন কেবল ঘুরিতেছে। একটা মাকড়সা। দুই দেয়ালের কোণে জাল বুনিতেছে অখণ্ড মনোযোগে । অনেক রাত্রি পর্যন্ত কাজল টেবিলে এবং হৈমন্তী খাটের পায়ের কাছে বসিয়া রহিল। ঝকঝকি শব্দ করিয়া রাচী-একৃসপ্রেস জামসেদপুরের দিকে রওনা হইয়া গেল। সমস্ত দিন। গরমের পর একটু ঠাণ্ডা বাতাস দিতেছে। ঘরে আলো নাই, অন্ধকারের ভিতর সমস্ত বাড়ীর শূন্যতাটা হৈমন্ত্রীর কাছে বেশী করিয়া ফুটিল। হঠাৎ বাইরে পায়ের শব্দ টি একটা পরিচিত গলার স্বর শোনা গেল । মানুষটি বারান্দায় উঠিল। সঙ্গে সঙ্গে ওভারসিয়ার বাবুর গলা-রাচীএকসপ্রেসেই এলেন বুঝি ? একটা দেশলাইয়ের কাঠি জ্বলিয়া উঠিল। অন্ধকারে । সেই আলোয় পথ দেখিয়া আসিতেছে। ঘরের মধ্যে আবার একটা কাঠি। জলিতে হৈমন্তী বিরক্তির সহিত মুখ ফিরাইল। কে আসিয়া তাহার মাথায় হাত রাখিয়া বলিল-ভয় নেই মা, আমি এসেছি। বাড়ি অন্ধকার কেন ? সুরপতিবাবু আসিয়াছেন। মালতীনগরে যাইবার আয়োজন হইতে লাগিল। সুরপতিবাবু, হৈমন্তী ও কাজলকে মালতীনগরে লইয়া যাইবেন । জিনিসপত্র প্রায় সবই এখানে রাখিয়া যাওয়া হইতেছে, লইয়া যাওয়া খুব কষ্টকর এবং তাহার প্রয়োজনও নাই। দুই’চারখানা কাপড় সঙ্গে যাইতেছে মাত্র। সুরপতিবাবু দিন পাচেক মৌপাহাড়ী থাকিলেন। মেয়ে সদ্য শোক পাইয়াছে, একটু সামলাইয়া নিক। বিকালের দিকে সতরঞ্জি পাতিয়া তিনি উঠানে বসেন। অন্যমনস্ক হইয়া চাহিয়া থাকেন কোন একদিকে । কিছুদিন আগে এইখানে বসিয়াই অপুর সহিত গল্প হইয়াছে। অপু বলিয়াছিলআত্মার বিনাশ নেই, বাবা । আত্মা একটা শক্তি। একটা ভীষণ শক্তিশক্তির বিনাশ নেই, রূপান্তর আছে মাত্র। পরলোকে বিশ্বাসী সুরপতিবাবু চারদিকে তাকাইয়া দেখেন। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা হইতেছে। তঁহার মনে হয়, এই মাটি-জল-বাতাসের ভিতর, ঐ দূরের নক্ষত্রটার ভিতর অপুর আত্মা রূপান্তরিত হইয়া মিশিয়া গিয়াছে। ዓS