পাতা:আনন্দমঠ - বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.djvu/১১৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
তৃতীয় খণ্ড—সপ্তম পরিচ্ছেদ
৯৫

“নিন্দসি যজ্ঞবিধেরহহ শ্রুতিজাতম্
সদয়-হৃদয়-দর্শিতপশুঘাতম্
কেশব ধৃতবুদ্ধশরীর
জয় জগদীশ হরে।”

 তখন বাহির হইতে কে অতি গম্ভীর রবে গায়িল, গম্ভীর মেঘগর্জ্জনবৎ তানে গায়িল;—

“ম্লেচ্ছনিবহনিধনে কলয়সি করবালম্
ধূমকেতুমিব কিমপি করালম্
কেশব ধৃতকল্কিশরীর
জয় জগদীশ হরে।”

 শান্তি ভক্তিভাবে প্রণত হইয়া সত্যানন্দের পদধূলি গ্রহণ করিল; বলিল, “প্রভো, আমি এমন কি ভাগ্য করিয়াছি যে, আপনার শ্রীপাদপদ্ম এখানে দর্শন পাই—আজ্ঞা করুন, আমাকে কি করিতে হইবে।” বলিয়া সারঙ্গে সুর দিয়া শান্তি আবার গাইল,—

“তব চরণপ্রণতা বয়মিতি ভাবয় কুরু কুশলং প্রণতেষু।”

 সত্যানন্দ বলিলেন, “মা, তোমার কুশলই হইবে।”

 শান্তি। কিসে ঠাকুর—তোমার ত আজ্ঞা আছে আমার বৈধব্য!

 সত্য। তোমারে আমি চিনিতাম না। মা! দড়ির জোর না বুঝিয়া আমি জেয়াদা টানিয়াছি, তুমি আমার অপেক্ষা জ্ঞানী, ইহার উপায় তুমি কর, জীবানন্দকে বলিও না যে, আমি সকল জানি। তোমার প্রলোভনে তিনি জীবন রক্ষা করিতে পারেন, এত দিন করিতেছেন। তাহা হইলে আমার কার্য্যোদ্ধার হইতে পারে।

 সেই বিশাল নীল উৎফুল্ল লোচনে নিদাঘকাদম্বিনীবিরাজিত বিদ্যুত্তুল্য ঘোর রোষকটাক্ষ হইল। শান্তি বলিল, “কি ঠাকুর! আমি আর আমার স্বামী এক আত্মা, যাহা যাহা তোমার সঙ্গে কথোপকথন হইল, সবই বলিব। মরিতে হয় তিনি মরিবেন, আমার ক্ষতি কি? আমি ত সঙ্গে সঙ্গে মরিব। তাঁর স্বর্গ আছে, মনে কর কি, আমার স্বর্গ নাই?”

 ব্রহ্মচারী বলিলেন যে, “আমি কখন হারি নাই, আজ তোমার কাছে হারিলাম। মা, আমি তোমার পুত্ত্র, সন্তানকে স্নেহ কর, জীবানন্দের প্রাণরক্ষা কর, আপনার প্রাণরক্ষা কর, আমার কার্য্যোদ্ধার হইবে।”