পেটের ভিতরে পাইয়া মানুষ করিয়াছিল। লোকে জানে যে, সে সেই জেলেরই মেয়ে।
যাহা হউক, রাজা অবিলম্বে সেই জেলের কাছে গিয়া বলিলেন, “আমি তোমার মেয়েকে বিবাহ করিতে চাহি।”
জেলে বলিল, “ইহার যে ছেলে হইবে, তাহাকে যদি আপনার সমস্ত রাজ্য দেন, তবে বিবাহ দিব, নহিলে দিব না।”
যদিও সেই মেয়েটিকে বিবাহ করিতে রাজার বড় ইচ্ছা হইয়াছিল, তথাপি দেবব্রতকে ছাড়িয়া অন্য কাহাকেও রাজ্য দিতে তিনি কিছুতেই প্রস্তুত ছিলেন না। সুতরাং সত্যবতীকে না লইয়া নিতান্ত দুঃখের সহিত তাঁহাকে ঘরে ফিরিতে হইল। সে দুঃখ এতই যে, তিনি তাহাতে দিন-দিন রোগা হইয়া যাইতে লাগিলেন।
দেবব্রত ভাবিলেন, তাইতো, বাবাকে কেন এমন দেখিতেছি?’ একদিন তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “বাবা কি হইয়াছে?”
রাজা বলিলেন, “আর কি হইবে বাবা! তোমার জন্যই ভাবি, তোমার পাছে কোনো অসুখ হয়, তাই আমার চিন্তা।”
দেবব্রত বুড়া মন্ত্রীকে বলিলেন, “মন্ত্রীমহাশয়, বাবার তো বড়ই অসুখ।” মন্ত্রী সকল কথাই জানেন, তিনি সেই জেলের মেয়ের কথা দেবব্রতকে বলিলেন।
এ কথা শুনিবামাত্র, অমনি দেবব্রত সবান্ধবে জেলের নিকট গিয়া বলিলেন, “আমার পিতার সহিত আপনার মেয়ের বিবাহ দিন।”
জেলে দেবব্রতকে অতিশয় আদর করিয়া বলিল, “রাজপুত্র আপনি যাহা বলিলেন, আমার পক্ষে তাহার চেয়ে সৌভাগ্যের কথা আর কি হইতে পারে? কিন্তু আমার মনে হইতেছে যে, এই বিবাহ হইলে শেষে একটা বিষম ঝগড়া ঝাঁটির কারণ হইবে। আপনার মতো বীরের সঙ্গে ঝগড়া করিয়া কি আর কেহ বাঁচিয়া থাকিতে পারে?”
দেবব্রত বুঝিলেন যে, পাছে রাজা লইয়া সত্যবতীর ছেলেদের সঙ্গে তাঁহার ঝগড়া হয়, জেলে সেই ভয় করিতেছে। তিনি তখনই বলিলেন “আমার সঙ্গে আপনার নাতিদের ঝগড়া হইবার কোনো ভয় থাকিবে না। কারণ, আমি এই প্রতিজ্ঞা করিতেছি যে, আমি রাজ্য লইব না, আপনার নাতিই আমাদের রাজা হইবে।”
জেলে বলিল, “রাজপুত্র, আপনি অতি মহাশয় লোক—আপনি যে আপনার কথামত কাজ করিবেন, তাহা আমি বেশ বুঝিতে পারিতেছি। কিন্তু আপনার ছেলেরা তো এ কথায় রাজি না হইতে পারেন!”
দেবব্রত বলিলেন, “আমার যদি ছেলে না হয়, তবে তো আর সে রাজ্য চাহিতে আসিবে না! আমি আবার এই প্রতিজ্ঞা করিতেছি যে, আমি বিবাহ করিব না।”
এ কথায় জেলে অত্যন্ত আহ্লাদিত হইয়া বলিল, “তবে আপনার পিতাকেই মেয়ে দিব।”
এদিকে আকাশ হইতে দেবতারা দেবব্রতের মাথায় পুষ্পবৃষ্টি করিতে লাগিলেন। আর তিনি যে ভয়ানক প্রতিজ্ঞা করিয়াছেন, তাহার জন্য তাঁহার নাম দিলেন ‘ভীষ্ম’ অথাৎ ভয়ানক লোক। তখন হইতে সকলে তাঁহার ‘দেবব্রত’ নাম ছড়িয়া দিয়া তাঁহাকে 'ভীষ্ম’ বলিয়াই ডাকিত।
জেলের অনুমতি লইয়া ভীষ্ম সত্যবতীকে বলিলেন “মা, রথে উঠুন ঘরে যাই!”