অধর্মের কথা মুখে আনেন নাই। অন্ধ স্বামীর দুঃখে তিনি এতই দুঃখিত ছিলেন যে, বিবাহের পরেই তিনি নিজের চক্ষু মোটা কাপড় দিয়া বাঁধিয়া ফেলেন। সে বাঁধন তাঁহার চিরদিন একভাবে ছিল। যুদ্ধের সময় যখন দুর্যোধনেরা জয়লাভের জন্য তাঁহার আশীর্বাদ চাহিতে আসিলেন, তখন গান্ধারী তাঁহাদেব মা হইয়াও এ কথা মুখে আনিতে পারিলেন না যে, ‘তোমাদের জয় হউক’, তিনি বলিলেন ‘ধর্মের জয় হউক’।
সেই দেবতার ন্যায় তেজস্বিনী ধার্মিকা রমণীর ক্রোধের কথা ভাবিয়াই পাণ্ডবেরা অত্যন্ত ভয় পাইয়াছিলেন। আর ক্রোধও তাঁহার খুবই হইয়াছিল। সেই ক্রোধে পাছে তিনি পাণ্ডবদিগকে শাপ দেন এই ভয়ে ব্যাসদেব পূর্বেই তাঁহাকে সতর্ক করিয়া বলিয়াছিলেন, “মা। তুমিই বলিয়াছিলে ‘ধর্মের জয় হউক’, সেই ধর্মের জয় হইয়াছে। তোমার যে অসাধারণ ক্ষমাগুণ, তাহাই ধর্ম, আর এখন যে ক্রোধ করিতেছ তাহা অধর্ম। মা। ধর্মের উপর যেন অধর্মের জয় না হয়।”
ইহার উত্তরে গান্ধারী বলিলেন, “ভগবন! পাণ্ডবদিগের উপর আমার ক্রোধ নাই তাহাদের বিনাশ আমি চাহি না। কিন্তু ভীম যে অন্যায়পূর্বক দুর্যোধনকে মারিয়াছে, ইহা আমি সহ্য করিতে পারিতেছি না।”
তাই ভীম গান্ধারীর নিকট উপস্থিত হইয়া ভয়ে ভয়ে বিনয়ের সহিত বলিলেন, “মা! আমার অপরাধ হইয়াছে। আপনি আমাকে ক্ষমা করুন। ভাবিয়া দেখুন, আপনার পুত্রেরা আমাদিগের বড়ই অনিষ্ট করিয়াছিল।”
গান্ধারী বলিলেন, “বাছা, আমার একশত পুত্রের মধ্যে যাহার কিছু কম অপরাধ, এমন একটিকেও যদি জীবিত রাখিতে, তাহা হইলেও সে এই দুই অন্ধের নডিস্বরূপ হইতে পারিত। এখন আমাদের পুত্র নাই কাজেই তুমি আমাদের পুত্রের মতন হইলে।”
তারপর যুধিষ্ঠির তাঁহার নিকট আসিয়া জোড়হাতে বলিলেন, “দেবী। আমিই আপনাদের দুঃখের মূল। আমি অতি নরাধম আমাকে শাপ দিন।”
গান্ধারী এ কথায় কোনো উত্তর না দিয়া, কেবল দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিলেন। সেই সময়ে যুধিষ্ঠির গান্ধীরীর পায়ে ধরিতে গেলে, গান্ধারী তাঁহার চোখের বাঁধনের ফাঁক দিয়া যুধিষ্ঠিরের আঙ্গুলের নখ দেখিতে পান। তদবধি যুধিষ্ঠিরের নখ মরিয়া গেল। তাহা দেখিয়া অর্জুন, সহদেব এবং নকুল ভয়ে আর তাঁহার নিকট আসিলেন না। তখন গান্ধারী তাঁহাদিগকে ডাকিয়া স্নেহের সহিত কথাবার্তা বলিতে লাগিলেন।
তারপর পাণ্ডবেরা কুন্তীর নিকটে গেলেন। এত দুঃখ-কষ্টের পর তাঁহাদিগকে, পাইয়া আর তাঁহাদিগকে অস্ত্রাঘাতে জর্জরিত এবং দ্রৌপদীকে পুত্রশোকে আকুল দেখিয়া, না জানি কুন্তীর কতই কষ্ট হইয়াছিল। কিন্তু সে কষ্টের দিকে মন না দিয়া, তিনি দ্রৌপদীকে সান্ত্বনা দিতে লাগিলেন।
তারপর সকলে মিলিয়া সেখান হইতে রণস্থলে গেলেন। তখন নিজ নিজ আত্মীয়গণের মৃত শরীর দেখিয়া তাঁহাদের যে দারুণ দুঃখ হইল, তাহার কথা অধিক বলিয়া আর কি হইবে? সেই মৃতদেহগুলির সৎকারই হইল তখনকার প্রথম কাজ। বহুমূল্য কাষ্ঠ, ঘৃত, চন্দনাদিতে অসংখ্য চিতা প্রস্তুত করিয়া যত্নপূর্বক সে কাজ শেষ করা হইলে, সকলে স্নান ও জলাঞ্জলি (অথাৎ যাহারা মরিয়াছে, তাহাদের উদ্দেশ্যে অঞ্জলি ভরিয়া জল) দিবার জন্য গঙ্গা তীরে