পুরীময় হাহাকার পড়িয়া গেল। রাজা সোনা হারিয়াছেন, রূপা হরিয়াছেন, তথাপি তিনি থামেন না, বারণ করিতে গেলে কথা শোনেন না।
সকলে পরামর্শ করিয়া সারথি বার্ষ্ণেয়কে পাঠাইল। সে দময়ন্তীর নিকট আসিয়া জোড়হাতে বলিল, “দেবি! পাত্রমিত্র সকলে মহারাজকে দেখিতে চাহে। দয়া করিয়া একটিবার তাহাকে বাহিরে পাঠান।”
তখন দময়ন্তী কাঁদিতে কাঁদিতে রাজাকে বলিলেন, “মহারাজ তোমার পায়ে পড়ি, একবার উঠিয়া বাহিরে চল, সকলে তোমাকে দেখিতে চাহে।”
কিন্তু রাজা তখন কলির হাতে, রানীর কথার উত্তর কে দিবে? দময়ন্তী যত কাদিলেন, তাহার কিছুই রাজার কানে গেল না। পাত্রমিত্রগণকে তাহার দর্শন না পাইয়া ফিরিতে হইল।
এইরূপে নানারকমে বারবার চেষ্টা করিয়াও কিছুতেই রাজার মতি ফিরান গেল না।
দময়ন্তী বুঝিলেন, আর রক্ষা নাই, এখন ছেলেটি আর মেয়েটিকে রক্ষা করিতে পারিলে হয়।
তাই তিনি সারথি বার্ষ্ণেয়কে ডাকাইয়া বলিলেন, “বাছা বার্ষ্ণেয়, রাজার যখন সময় ছিল, তখন তিনি তোমাদের অনেক করিয়াছে, এখন এই অসময়ে তাহার কিছু উপকার কর। আমাদের যাহা হইবার হইবে, কিন্তু ইন্দ্রসেন আর ইন্দ্রসেনার দুঃখ দেখিতে পারিব না। বাছা, তুমিই এই বিপদে আমার একমাত্র ভরসা। তুমি ইহাদের দুজনকে বিদর্ভ দেশে আমার পিতার নিকট লইয়া যাও। সেখানে তাহাদিগকে রাখিযা ইচ্ছা হয় সেখানে থাকিও, নাহয় অন্য কোথাও যাইও।”
রাণীর কথায় বার্ষ্ণেয় ছেলেটি আর মেয়েটিকে লইয়া, তখনই বিদর্ভ দেশে চলিয়া গেল। সেখানে তাহাদের দুজনকে, আর রথখানি আর ঘোড়াগুলিকে রাখিয়া, সে অযোধ্যায় গিয়া সেখানকার রাজা ঋতুপর্ণের নিকট কাজ লইল। ঋতুপর্ণের সারথি হইযা তাহাব ভাতকাপড়ের চিন্তা গেল বটে। কিন্তু মনের দুঃখ দূর আর হইল না।
এদিকে নলের দুঃখের কথা আর কি বলিব। হারিতে হারিতে তিনি সর্বস্ব খোয়াইয়া ফকির হইয়া দময়ন্তীকে লইয়া পথে বাহির হইয়াছে! গায়ের চাদরখানি পর্যন্ত নাই। সঙ্গে একটি লোকও নাই। পুষ্কর পাশায় জিতিয়া, যত মুখে আসিয়াছে, ততই তাহাকে বিদ্রুপ করিয়াছে। শেষে সেই দুরাত্মা রাজ্যে ঘোষণা করিয়া দিয়াছে, “যে নলের হইয়া কথা বলিবে, তাহাকে কাটিয়া ফেলিব।”
কাজেই প্রজারা গোপনে কেবল চোখের জল ফেলে, কিন্তু রাজাকে দেখিলে কথা কয় না।
নগরের কাছেই একটি বনের ভিতরে, কেবল জল খাইয়া,নল দময়ন্তী তিনদিন কাটাইলেন। তারপর দুজনে অতিকষ্টে, বনের ফল মূল খাইয়া জীবনধারণ করিতে লাগিলেন।
এমন করিয়া কিছুদিন গেল। তারপর একদিন নল দেখিলেন, বনের ভিতর এক ঝাঁক পাখি চরিতেছে, তাহাদের পালক গুলি সোনার। আহা! নলের মনে সেই পাখিগুলি দেখিয়া কি আনন্দই হইল। তিনি ভাবিলেন, “পাখিগুলি মারিয়া খাইব, আর পালকগুলি বেচিয়া পয়সা পাইব।”
এই ভাবিয়া তিনি লতা পাতায় শরীর উত্তমরূপে ঢাকিয়া, নিজের কাপড় খানি দিয়া সেই