পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২৮৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

૨૧ ૭ গল্পগুচ্ছ শরৎবাবর আশ্রয়ে চন্দননগরের বাগানে বাস করিতে করিতে নীলকাতের উপর স্বভাবের নিয়ম অব্যাহতভাবে আপন কাজ করিতে লাগিল। সে এতদিন যে একটা বয়ঃসন্ধিস্থলে অস্বাভাবিকভাবে দীঘকাল থামিয়াছিল এখানে আসিয়া সেটা কখন এক সময় নিঃশব্দে পার হইয়া গেল। তাহার সতেরো-আঠারো বৎসরের বয়ঃক্রম বেশ সম্পন্ণভাবে পরিণত হইয়া উঠিল। তাহার সে পরিবতন বাহির হইতে কাহারও চোখে পড়িল না কিন্তু তাহার প্রথম লক্ষণ এই যে, যখন কিরণ নীলকাতের প্রতি বালকযোগ্য ব্যবহার করিতেন সে মনে মনে লজিত এবং ব্যথিত হইত। একদিন আমোদপ্রিয় কিরণ তাহাকে সত্ৰীবেশে সখী সাজিবার কথা বলিয়াছিলেন, সে কথাটা অকস্মাৎ তাহার বড়োই কষ্টদায়ক লাগিল অথচ তাহার উপযুক্ত কারণ খুজিয়া পাইল না। আজকাল তাহাকে যাত্রার অননুকরণ করিতে ডাকিলেই সে অদশ্য হইয়া ষাইত। সে যে একটা লক্ষীছাড়া যাত্রার দলের ছোকরার অপেক্ষা অধিক কিছ নয়, এ কথা কিছুতে তাহার মনে লইত না । এমন কি, সে বাড়ির সরকারের নিকট কিছু কিছু করিয়া লেখাপড়া শিখিবার ংকল্প করিল। কিন্তু বউঠাকরনের স্নেহভাজন বলিয়া নীলকান্তকে সরকার দলই চক্ষে দেখিতে পারিত না, এবং মনের একাগ্রতা রক্ষা করিয়া পড়াশুনো কোনো কালে অভ্যাস না থাকাতে অক্ষরগুলো তাহার চোখের সামনে দিয়া ভাসিয়া যাইত। গঙ্গার ধারে চাঁপাতলায় গাছের গড়িতে ঠেসান দিয়া কোলের উপর বই খুলিয়া সে দীর্ঘকাল বসিয়া থাকিত; জল ছল ছল করিত, নৌকা ভাসিয়া যাইত, শাখার উপরে চঞ্চল অন্যমনস্ক পাখি কিচমিচ শব্দে সবগত উক্তি প্রকাশ করিত, নীলকান্ত বইয়ের পাতায় চক্ষ রাখিয়া কী ভাবিত সেই জানে অথবা সেও জানে না। একটা কথা হইতে কিছতেই আর-একটা কথায় গিয়া পৌছিতে পারিত না, অথচ বই পড়িতেছি মনে করিয়া তাহার ভারি একটা আত্মগৌরব উপস্থিত হইত। সামনে দিয়া যখন একটা নৌকা যাইত তখন সে আরও অধিক আড়ম্বরের সহিত বইখানা তুলিয়া বিড় বিড় করিয়া পড়ার ভান করিত ; দশক চলিয়া গেলে সে আর পড়ার উৎসাহ রক্ষা করিতে পারিত না। পবে সে অভ্যস্ত গানগুলো যন্ত্রের মতো যথানিয়মে গাহিয়া যাইত, এখন সেই গানের সরেগুলো তাহার মনে এক অপব চাঞ্চল্য সঞ্চার করে। গানের কথা অতি যৎসামান্য, তুচ্ছ অন্যপ্রাসে পরিপণ", তাহার অর্থও নীলকান্তের নিকট সম্যক বোধগম্য নহে, কিন্তু যখন সে গাহিত ওরে রাজহংস, জমি বিজবংশে এমন নশংস কেন হলি রে— বল কী জন্যে, এ অরণ্যে রাজকন্যের প্রাণসংশয় করিলি রে--- তখন সে যেন সহসা লোকান্তরে জন্মান্তরে উপনীত হইত ; তখন চারি দিকের অভ্যন্ত জগৎটা এবং তাহার তুচ্ছ জীবনটা গানে তজমা হইয়া একটা নতন চেহারা ধারণ করত। রাজহংস এবং রাজকন্যার কথা হইতে তাহার মনে এক অপরাপ ছবির আভাস জাগিয়া উঠিত, সে আপনাকে কী মনে করিত পাট করিয়া বলা যায় না, কিন্তু যাত্রার দলের পিতৃমাতৃহীন ছোকরা বলিয়া ভুলিয়া যাইত। নিতান্ত