পাতা:গোরা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৫৬১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

তাঁহার পদশব্দে বিনয়ের উৎসাহপ্রবাহ বন্ধ হইয়া গেল; সে গোরার কাছে বিদায় লইয়া চলিয়া গেল।

 গোরা ছাতের উপর দাঁড়াইয়া পূর্বদিকের রক্তিম আকাশে চাহিয়া একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল। অনেক ক্ষণ ধরিয়া ছাতে বেড়াইল, আজ তাহার আর গ্রামে যাওয়া হইল না।

 আজকাল গোরা নিজের হৃদয়ের মধ্যে যে-একটি আকাঙ্ক্ষা, যে-একটি পূর্ণতার অভাব অনুভব করিতেছে, কোনোমতেই কোনো কাজ দিয়াই তাহা সে পুরণ করিতে পারিতেছে না। শুধু সে নিজে নহে, তাহার সমস্ত কাজও যেন উর্ধ্বের দিকে হাত বাড়াইয়া বলিতেছে, ‘একটা আলো চাই, উজ্জ্বল আলো, সুন্দর আলো!’ যেন আর-সমস্ত উপকরণ প্রস্তুত আছে, যেন হীরামানিক সোনারূপা দুর্‌মূল্য নয়, যেন লৌহ বজ্র বর্ম চর্ম দুর্লভ নয়, কেবল আশা ও সান্ত্বনায় উদ্‌ভাসিত স্নিগ্ধসুন্দর অরুণরাগমণ্ডিত আলো কোথায়! যাহা আছে তাহাকে আরও বাড়াইয়া তুলিবার জন্য কোনো প্রয়াসের প্রয়োজন নাই- কিন্তু তাহাকে সমুজ্জ্বল করিয়া, লাবণ্যময় করিয়া, প্রকাশিত করিয়া তুলিবার যে অপেক্ষা আছে।

 বিনয় যখন বলিল, কোনো কোনো মাহেন্দ্রক্ষণে নরনারীর প্রেমকে আশ্রয় করিয়া একটি অনির্বচনীয় অসামান্যতা উদ্‌ভাসিত হইয়া উঠে, তখন গোরা পূর্বের ন্যায় সে কথাকে হাসিয়া উড়াইয়া দিতে পারিল না। গোরা মনে মনে স্বীকার করিল, তাহা সামান্য মিলন নহে, তাহা পরিপূর্ণতা, তাহার সংস্রবে সকল জিনিসেরই মূল্য বাড়িয়া যায়; তাহা কল্পনাকে দেহ দান করে ও দেহকে প্রাণে পূর্ণ করিয়া তোলে; তাহা প্রাণের মধ্যে প্রাণন ও মনের মধ্যে মননকে কেবল যে দ্বিগুণিত করে তাহা নহে, তাহাকে একটি নৃতন রসে অভিষিক্ত করিয়া দেয়।

 বিনয়ের সঙ্গে আজ সামাজিক বিচ্ছেদের দিনে বিনয়ের হৃদয় গোরার হৃদয়ের ‘পরে একটি অখণ্ড একতান সংগীত বাজাইয়া দিয়া গেল। বিনয় চলিয়া গেল, বেলা বাড়িতে লাগিল, কিন্তু সে সংগীত কোনোমতেই থামিতে

৫৪৯