পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১২৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
চোখের বালি
১২৫

তুলিয়া আসিয়া রাজলক্ষ্মীর কাছে বসিল। কহিল, “বিহারী-ঠাকুরপো কখনো তোমাদের তত্ত্ব লইতে ভোলেন না। বেচারার নিজের মা নাই নাকি, তাই তোমাকেই মার মতো দেখেন।”

 বিহারীকে রাজলক্ষ্মী এমনি মহেন্দ্রের ছায়া বলিয়া জানিতেন যে, তাহার কথা তিনি বিশেষ কিছু ভাবিতেন না— সে তাঁহাদের বিনা মূল্যের, বিনা যত্নের, বিনা চিন্তার অনুগত লোক ছিল। বিনোদিনী যখন রাজলক্ষ্মীকে মাতৃহীন বিহারীর মাতৃস্থানীয়া বলিয়া উল্লেখ করিল, তখন রাজলক্ষ্মীর মাতৃহৃদয় অকস্মাৎ স্পর্শ করিল। হঠাৎ মনে হইল, ‘তা বটে, বিহারীর মা নাই এবং আমাকেই সে মার মতো দেখে।’ মনে পড়িল, রোগে তাপে সংকটে বিহারী বরাবর বিনা আহ্বানে, বিনা আড়ম্বরে, তাঁহাকে নিঃশব্দে নিষ্ঠার সহিত সেবা করিয়াছে। রাজলক্ষ্মী তাহা নিশ্বাসপ্রশ্বাসের মতো সহজে গ্রহণ করিয়াছেন এবং সেজন্য কাহারো কাছে কৃতজ্ঞ হওয়ার কথা তাঁহার মনেও উদয় হয় নাই। কিন্তু বিহারীর খোঁজখবর কে রাখিয়াছে। যখন অন্নপূর্ণা ছিলেন তিনি রাখিতেন বটে; রাজলক্ষ্মী ভাবিতেন, ‘বিহারীকে বশে রাখিবার জন্য অন্নপূর্ণা স্নেহের আড়ম্বর করিতেছেন।’

 রাজলক্ষ্মী আজ নিশ্বাস ফেলিয়া কহিলেন, “বিহারী আমার আপন ছেলের মতোই বটে।”

 বলিয়াই মনে উদয় হইল, বিহারী তাঁহার আপন ছেলের চেয়ে ঢের বেশি করে— এবং কখনো বিশেষ কিছু প্রতিদান না পাইয়াও তাঁহাদের প্রতি সে ভক্তি স্থির রাখিয়াছে। ইহা ভাবিয়া তাঁহার অন্তরের মধ্য হইতে দীর্ঘনিশ্বাস পড়িল।

 বিনোদিনী কহিল, “বিহারী-ঠাকুরপো তোমার হাতের রান্না খাইতে বড়ো ভালোবাসেন!”

 রাজলক্ষ্মী সস্নেহ গর্বে কহিলেন, “আর-কারো মাছের ঝোল তাহার মুখে রোচে না।”

 বলিতে বলিতে মনে পড়িল, অনেকদিন বিহারী আসে নাই। কহিলেন, “আচ্ছা বউ, বিহারীকে আজকাল দেখিতে পাই না কেন।”

 বিনোদিনী কহিল, “আমিও তো তাই ভাবিতেছিলাম, পিসিমা তা, তোমার ছেলেটি বিবাহের পর হইতে নিজের বউকে লইয়াই এমনি মাতিয়া রহিয়াছে— বন্ধুবান্ধবরা আসিয়া আর কী করিবে বলো।”

 কথাটা রাজলক্ষ্মীর অত্যন্ত সংগত বোধ হইল। স্ত্রীকে লইয়া মহেন্দ্র তাঁহার সমস্ত হিতৈষীদের দূর করিয়াছে। বিহারীর তো অভিমান হইতেই হয়— যেন