পাতা:চোখের বালি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৮৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
চোখের বালি
৮৫

 বিনোদিনী কহিল, “একবার শুনেই যাও-না।”

 বিহারী ঘরে ঢুকিয়াই মুহূর্তের মধ্যে একবার আশার দিকে চাহিল— ঘোমটার মধ্য হইতে আশার মুখ যতটুকু দেখিতে পাইল, সেখানে বিষাদ বা বেদনার কোনো চিহ্নই তো দেখা গেল না। আশা উঠিয়া যাইবার চেষ্টা করিল, বিনোদিনী তাহাকে জোর করিয়া ধরিয়া রাখিল; কহিল, “আচ্ছা বিহারী-ঠাকুরপো, আমার চোখের বালির সঙ্গে কি তোমার সতিন-সম্পর্ক। তোমাকে দেখলেই ও পালাতে চায় কেন?”

 আশা অত্যন্ত লজ্জিত হইয়া বিনোদিনীকে তাড়না করিল।

 বিহারী হাসিয়া উত্তর করিল, “বিধাতা আমাকে তেমন সুদৃশ্য করিয়া গড়েন নাই বলিয়া।”

 বিনোদিনী। দেখছিস ভাই বালি? বিহারী-ঠাকুরপো বাঁচাইয়া কথা বলিতে জানেন— তোর রুচিকে দোষ না দিয়া বিধাতাকেই দোষ দিলেন। লক্ষ্মণটির মতো এমন সুলক্ষণ দেবর পাইয়াও তাহাকে আদর করিতে শিখিলি না— তোরই কপাল মন্দ।

 বিহারী। তোমার যদি তাহাতে দয়া হয় বিনোদ-বোঠান, তবে আর আমার আক্ষেপ কিসের।

 বিনোদিনী। সমুদ্র তো পড়িয়া আছে, তবু মেঘের ধারা নহিলে চাতকের তৃষ্ণা মেটে না কেন।

 আশাকে ধরিয়া রাখা গেল না। সে জোর করিয়া বিনোদিনীর হাত ছাড়াইয়া বাহির হইয়া গেল। বিহারীও চলিয়া যাইবার উপক্রম করিতেছিল। বিনোদিনী কহিল, “ঠাকুরপো, মহেন্দ্রবাবুর কী হইয়াছে বলিতে পার?”

 শুনিয়াই বিহারী থমকিয়া ফিরিয়া দাঁড়াইল। কহিল, “তাহা তো জানি না। কিছু হইয়াছে নাকি।”

 বিনোদিনী। কী জানি ঠাকুরপো, আমার তো ভালো বোধ হয় না।

 বিহারী উদ্বিগ্নমুখে চৌকির উপর বসিয়া পড়িল। কথাটা খোলসা শুনিবে বলিয়া বিনোদিনীর মুখের দিকে ব্যগ্র ভাবে চাহিয়া অপেক্ষা করিয়া রহিল। বিনোদিনী কোনো কথা না বলিয়া মনোযোগ দিয়া চাদর সেলাই করিতে লাগিল।

 কিছুক্ষণ প্রতীক্ষা করিয়া বিহারী কহিল, “মহিনদার সম্বন্ধে তুমি কি বিশেষ কিছু লক্ষ্য করিয়াছ।”

 বিনোদিনী অত্যন্ত সাধারণভাবে কহিল, “কী জানি ঠাকুরপো, আমার তো