পাতা:জীবনের ঝরাপাতা.pdf/১৩৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

দরকারটা কি? খাওয়াপরার অভাব তো নেই; কেন খামকা নিজেকে এমন বিপদগ্রস্ত করা? এ খালি বিলিতী সভ্যতার অনুকরণ।”

 ভেবে দেখলাম কথাটা কতকটা সত্য। বিলিতী গল্প পড়ে পড়ে মনের ভিতর জমে ওঠা একটা সখের হাওয়ার ঘূর্ণিতে অনেকদূর এসে পড়া আমার। দাদাদের সঙ্গে শিক্ষাদীক্ষায় সমান সুযোগ লাভ করে নরনারীর স্বায়ত্ত জীবিকা অর্জনে সমান দাবী প্রতিপন্ন করাই আমার চাকরী করতে আসার মূল প্রেরণা ছিল না—চেতনার তলায় তলায় সেটা থাকলেও উপর উপর অতি প্রবলভাবে সখই তার প্রধান উপাদান ছিল। একটা cause ধরলে মানুষ তার উপর মজবুত হয়ে দাঁড়িয়ে থাক্‌তে পারে—তাতেই তার মনুষ্যত্ব। কিন্তু সখের ভিত্তি, বালুর ভিত্তি—ধ্বসে ধ্বসে যায়, সরে সরে যায়, সখ কিছুদিন পরে মিটে যায়। আমারো ছমাসের পরে মিটে আসতে লাগল।

 এর উপর আর একটা দৈব উৎপাত এল—ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হলুম। এখানকার সাহেব সিভিল সার্জেনের চিকিৎসা ও ঔষধপত্র চলতে থাকল। বাড়িতে এত বয়স পর্যন্ত এলোপ্যাথী ওষুধ কখনও খাইনি, তার কি রকম স্বাদ, তা জানতুমই না। বাবামহাশয় হোমিওপ্যাথির ঘোরতর বিশ্বাসী ও ভক্ত। আমাদের অল্পস্বল্প অসুখ হোক বা বেশী হোক, ডাক্তার মহেন্দ্র সরকার বা ডাক্তার সল্‌জার ছাড়া কাউকে ডাকা হয় না। বিশ বৎসর বয়সের পর জীবনে প্রথম এলোপ্যাথী ওষুধের সঙ্গে আমার শারীরিক পরিচয় হল। মা-দের কাছে টেলিগ্রাম গেল। মা তখনো সাতারায় ছিলেন। সেখান থেকে তিনি এলেন অসুখে আমার তত্ত্বাবধানের জন্যে। একটু ভাল হলে সিভিল সার্জেন মাকে বললেন, আমায় মহীশূরে রাখা এখন সমীচীন নয়, স্থানান্তরে নিয়ে যাওয়া উচিত—এখানে এই সময় ম্যালেরিয়ার প্রকোপ বেশী। তিন মাসের ছুটি নিয়ে মা-র সঙ্গে প্রথমে সাতারায় গেলুম আমি। তিন মাসের পর মহীশূরে এসে আর তিনমাস থেকে এক বছর পূর্ণ হলে কাজে ইস্তফা দিয়ে ঘরের মেয়ে ঘরে ফিরলুম। কলকাতায় যেখানে যাই, যার সঙ্গে দেখা হয়, সে-ই ঠাট্টা করে—“চাকরীর সখ মিটল? স্বাধীন হবার সখ মিটল?’’

 চাকরীর সখ মিটেছিল বটে, কিন্তু স্বাধীন হবার সখ মেটেনি। শুধ, ব্যক্তিগত স্বাধীনতার সখ ব্যাপক হয়ে জাতি ও দেশগত স্বাধীনতার সখের রূপ নিলে। সখ আর সখমাত্র রইল না, cause-এর আকার ধারণ করলে। আমার নিজের পায়ে ভর করে দেশান্তরে গমন ও অবস্থানে যে

১২৪