বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:টমাস বাটার আত্মজীবনী - বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
আমার শৈশব

যতদূর আমার স্মরণ হয় আমার প্রথম শিক্ষা প্রার্থনা আবৃত্তি করা। আমার শৈশবাবস্থাতেই আমার ধর্মপরায়ণা মাতা রোমান ক্যাথলিক ধর্মানুযায়ী প্রার্থনা আমাকে মুখস্থ করান। বাড়িতে কেউ বেড়াতে এলেই তাঁদের সামনে আমাকে বিদ্যা জাহির করতে হ'ত এবং প্রায়ই একটি পেনি দ্বারা তাঁরা আমায় পুরস্কৃত করতেন।

ছ'বছর বয়সে আমি চামড়ার অকেজো টুকরো টাকরা জোড়াতালি দিয়ে জুতো তৈরি করতাম, তাদের ছাঁচগুলির পরিকল্পনাও আমি নিজেই করতাম। অবশ্য এই সব টুকরো দিয়ে মানুষের বুড়ো আঙ্গুলের চেয়ে বড় জুতো তৈরি করা সম্ভব ছিল না কিন্তু তা সত্যিকার জুতোর মতই হ'ত। আমার মত শিশুর হাতের কাজ বলেই সেগুলির চাহিদাও ছিল মন্দ নয়। সারাদিনের পরিশ্রমের ফলে এই ধরণের এক জোড়া জুতো তৈরি হ'তে পারত। চার থেকে দশ ক্রিউজার ছিল এর মূল্য। মজুরি হিসাবে নিতান্ত নগণ্য নয়, কারণ চার ক্রিউজার সে সময় বিলিতি পেনির সমান বড় মুদ্রা ছিল অবিমিশ্র তামার তৈরি। দশ ক্রিউজার ছিল বিলিতি ছ' পেনির সমান আকারের একটি রৌপ্য মুদ্রা।

ইস্টারের সময় আমরা একটা মজার খেলা করতাম। সব ছেলে এক জায়গায় জড় হয়ে খেলাটা সুবু করে দেওয়া হ'ত, ছেলেদের ভেতর থেকে একজনকে করা হ'ত সর্দার। খেলার মাঠে দেরিতে পৌঁছালে জরিমানা দেওয়ার নিয়ম ছিল। জরিমানা এড়াবার জন্য আমি আর আমার ভাই রাত চারটের সময় উঠে খেলার মাঠে যেতাম। তবুও দেখতাম আমাদের আগে প্রায় সব ছেলেই সেখানে জড় হয়েচে। অতএব আমাদের জরিমানা দিতেই হ'ত।

জরিমানার টাকা এক জায়গায় জড় করে আমাদের মধ্যেই সেটা ভাগ হ'ত। আমি কত টাকা জরিমানা উঠল এবং সে হিসেবে প্রত্যেক ছেলের ভাগে কত পড়া উচিত তার একটা হিসেব রাখতাম। কিন্তু সর্দার ও ক্যাশিয়ারের হিসেবের সঙ্গে তার মিল হ'ত না। আমার হিসেব অনুযায়ী যার যেটা ন্যায্য পাওনা তারা প্রকৃতপক্ষে পেত তার অর্ধেক। মানুষের এই অবিচারে আমার মনে যে ক্রোধ, বিরক্তি কর চাঞ্চল্যের আলোড়ন তুললো তা অসীম এবং আমি নিতান্ত অনভিজ্ঞ যুবক বলেই তা সম্ভব হয়েছিল। তখনি আমার পিতাকে সব খুলে বলে তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করলাম। তিনি আমায় বললেন জগতের নিয়মই এই। এই নিয়ে তিনি কারো সঙ্গে ঝগড়া করতে পারবেন না, এবং আমার যে ক্ষতি হয়েছে তিনি নিজের পকেট থেকেই সেটা দিয়ে দেবেন।

এই সময় থেকে আমি সাপ্তাহিক মেলায় যেতে সুরু করেছি, বাবার সঙ্গে। বাবার খরিদ্দারদের জুতো পরানো, জুতো খোলা প্রভৃতি কাজ করে দিতাম, তারা আমায় কিছু কিছু বখশিস দিত, সে বখশিসের অঙ্ক শূন্য থেকে আরম্ভ করে এক পেনি পর্যন্ত এক একবার জনপিছু। ডাকঘরের সেভিংস্ ব্যাঙ্কে আমার এ আয় জমিয়ে রাখতাম। পাঁচ ক্রিউজারের ডাক টিকিট কিনে একটা কার্ডে আঠা দিয়ে এঁটে রাখতে হ'ত। দশটা স্ট্যাম্পে আঁটা কার্ড পোষ্টমাস্টারকে দিলে টাকাটা যার কার্ড তার নামে জমা হয়ে যেত।