পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/১২৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 চাঁদ বলিলেন,— “যদি তুমি এরূপ সমূহ বিপদ হইতে আমাকে রক্ষা না করিবে, তবে তুমি আকাশের মাহিনা খাও কি জন্য?”

 সিপাহী উত্তর করিলেন,— “রেখে দাও তোমার মাহিনা! না হয় কর্ম্ম ছাড়িয়া দিব? পৃথিবীতে গিয়া কনেষ্টেবিলি করিয়া খাইব। আমা হেন প্রসিদ্ধ দুৰ্দ্ধান্ত সিপাহী পাইলে, সেখানে তাহারা লুফিয়া লইবে। সেখানে এমন মূল-শিকড় কাটাকাটি নাই। সেখানে দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয় বটে, তা দাঙ্গা-হাঙ্গামার সময় আমি তফাৎ তফাৎ থাকিব। দাঙ্গা-হাঙ্গামা সব হইয়া যাইলে দাঙ্গাবাজেরা আপনার আপনার ঘরে চলিয়া গেলে, তখন আমি রাস্তার দুচারি জন ভালমানুষ ধরিয়া, কাছারিতে নিয়া হাজির করিব। তবে এখন আমি যাই। কারণ, মানুষটি যদি আসিয়া পড়ে? শেষে যদি আমাকে পর্যন্ত ধরিয়া টানাটানি করে?”

 এই কথা বলিয়া, দুৰ্দান্ত সিপাহী সেখান হইতে অতি দ্রুতবেগে প্রস্থান করিলেন। নিরুপায় হইয়া “যা থাকে কপালে”, এই মনে করিয়া, চাঁদ আকাশে গা ঢালিয়া দিলেন।

 মেঘের ডালে খোক্কোশ বাঁধিয়া আকাশের মাঠ দিয়া কঙ্কাবতী অতি দ্রুতবেগে চাঁদের দিকে ধাবমান হইলেন।

 চারিদিকে জনরব উঠিল যে, আকাশবাসী আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার সকলের মূল-শিকড় কাটিতে পৃথিবী হইতে মনুষ্য আসিয়াছে। আকাশবাসীরা সকলে আপনার আপনার ছেলেপিলে সাবধান করিয়া, ঘরে খিল দিয়া বসিয়া রহিল। নক্ষত্রগণের পলাইবার যো নাই, তাই নক্ষত্রগণ বন-উপবনে, ক্ষেত্র-উদ্যানে, যে যেখানে ফুটিয়াছিল, সে সেইখানে বসিয়া মিট-মিট করিয়া জ্বলিতে লাগিল। চাঁদের পলাইবার যো নাই, কারণ, জগতে আলো না দিয়া পলাইলে জরিমানা হইবে, চাঁদ তাই বিরসমনে ম্লানবদনে ধীরে ধীরে আকাশের পথে ভ্রমণ করিতে লাগিলেন।

 চাঁদ ভাবিলেন,— “এইবার তো দেখিতেছি, আমার মূল-শিকড়টি কাটা যায়। এখন আমি শুদ্ধ না যাই, তবেই রক্ষা। এরে বিশ্বাস কি? যদি বলিয়া বসে যে,— 'বাঃ! দিব্য চাঁদটি, কাপড়ে বাঁধিয়া লইয়া যাই!' তাহা হইলে আমি কি করিতে পারি? কাজ নাই বাপু! আমি চক্ষু বুজিয়া থাকি, নিশ্বাস বন্ধ করি, মড়ার মত কাঠ হইয়া থাকি। মানুষটা মনে করিবে যে, এ মরা চাঁদ লইয়া আমি কি করিব? আমাকে সে আর ধরিয়া লইয়া যাইবে না।”

 বুদ্ধিমন্ত চাঁদ এইরূপ মনে মনে পরামর্শ করিয়া চক্ষু বুজিলেন, নিশ্বাস বন্ধ করিয়া রহিলেন।

 চাঁদকে বিবর্ণ, বিষন্ন মৃত্যু-ভাবাপন্ন দেখিয়া কঙ্কাবতী ভাবিলেন,— “বাঃ, চাঁদটি বা মরিয়া গেল? মূল-শিকড়টি কাটিয়া লইব, সেই ভয়ে চাঁদের বা প্রাণত্যাগ হইল। আহা, কেমন সুন্দর চাঁদটি ছিল! কেমন চমৎকার জ্যোৎস্না হইত, কেমন পূর্ণিমা হইত! সে সকল আর হইবে না। চিরকাল অমাবস্যার রাত্রি থাকিবে। লোকে আমায় কত গালি দিবে।”

 একটু ভাল করিয়া দেখিয়া কঙ্কাবতী পুনরায় মনে মনে বলিলেন,— “না, চাঁদটি মরে নাই। বোধ হয় মূৰ্ছা গিয়াছে। তা ভালই হইয়াছে। কাটিতে-কুটিতে হইলে, ডাক্তারেরা প্রথম ঔষধ শুকাইয়া অজ্ঞান করেন, তারপর করাত দিয়া হাত-পা কাটেন। ভালই হইয়াছে যে, চাঁদ আপনা-আপনি অজ্ঞান হইয়াছে। মূল-শিকড় কাটিতে ইহাকে আর লাগিবে না। কিন্তু শিকড়টি একেবারে দুইখণ্ড করিয়া কাটা হইবে না, তাহা হইলে চাঁদ মরিয়া যাইবে। আমার কেবল একতোলা শিকড়ের ছালের প্রয়োজন, ততটুকু আমি কাটিয়া লই।”

 এইরূপ ভাবিয়া চারিদিক ঘুরিয়া, কঙ্কাবতী অবশেষে চাঁদের মূল-শিকড়টি দেখিতে

কঙ্কাবতী
১১৭