পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/১৩২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

দিয়া বসিয়া আছে। সবাই সশঙ্কিত।”

 কঙ্কাবতী বলিলেন,— “আমার কাজ সারা হইয়াছে সত্য, কিন্তু আমার কতগুলি নক্ষত্র চাই। আমাদের সেখানে নক্ষত্র নাই। আহা! এখানে কেমন চারিদিকে সুন্দর সুন্দর সব নক্ষত্র ফুটিয়া রহিয়াছে! আমি মনে করিয়াছি, কতকগুলি নক্ষত্র এখান হইতে তুলিয়া লইয়া যাইব। এখান হইতে অনেক দূরে আমার খোক্কোশ বাঁধা আছে। কি করিয়া নক্ষত্রগুলি ততদূর লইয়া যাই? একটি মুটে কোথায় পাই?”

 চাঁদনী বলিলেন,— “আর বাছা! তোমার ভয়ে ঘর হইতে আর কি লোক বাহির হইয়াছে, যে তুমি মুটে পাইবে? দোকানী-পসারী সব দোকান বন্ধ করিয়াছে, আকাশের বাজার-হাট আজ সব বন্ধ। পথে জনপ্রাণী নাই। আমিই কেবল প্রাণের দায়ে ঘর হইতে বাহির হইয়াছি।”

 এইরূপ কথাবার্ত্তা হইতেছে, এমন সময় কঙ্কাবতী দেখিতে পাইলেন যে, মেঘের পাশে লুকাইয়া কে একটি লোক উঁকিঝুঁকি মারিতেছে। কঙ্কাবতী ভাবিলেন,— “ঐ লোকটিকে বলি, খোক্কোশের বাচ্ছার কাছ পর্যন্ত নক্ষত্রগুলি দিয়া আসে।” এইরূপ চিন্তা করিয়া কঙ্কাবতী তাহাকে ডাকিলেন। কঙ্কাবতী বলিলেন,— “ওগো শুন! একটা কথা শুন!”

 কঙ্কাবতী যেই এই কথা বলিয়াছেন, আর লোকটি উৰ্দ্ধশ্বাসে ছুটিয়া পলাইল। কঙ্কাবতী তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ দৌড়িলেন। কঙ্কাবতী বলিতে লাগিলেন,— “ওগো! একটু দাঁড়াও! আমার একটা কথা শুন! তোমার কোনও ভয় নাই!”

 আর ভয় নাই! কঙ্কাবতী যতই তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ যান, আর লোকটি ততই প্রাণপণে দৌড়িতে থাকে। কৃষ্ণাবতী মনে করলেন— “লোকটি কি দৌড়িতে পারে! বাতাসের মত যেন উড়িয়া যায়।”

 কঙ্কাবতী তাহাকে কিছুতেই ধরিতে পারিলেন না, কিন্তু দৈবক্রমে একটিপি মেঘ তাহার পায়ে লাগিয়া সে হেঁচোট খাইয়া পড়িয়া গেল। পড়িয়াও পুনরায় উঠিতে কত চেষ্টা করিল, কিন্তু উঠিতে না উঠিতে কঙ্কাবতী গিয়া তাহাকে ধরিয়া ফেলিলেন!

 কঙ্কাবতী তাহার গায়ে হাত দিয়া দেখেন যে, তাহার গায়ে হাড় নাই, মাংস নাই, কিছুই নাই! দেহ তার অতি লঘু। দুইটি অঙ্গুলি দ্বারা কঙ্কাবতী তাহাকে ধরিয়া তুলিলেন। চক্ষুর নিকট আনিয়া নিরীক্ষণ করিয়া দেখিলেন যে, কেবল দুই-চারিটি তালপাতা দিয়া তাহার শরীর নির্ম্মিত। তালপাতের হাত, তালপাতের পা, তালপাতের নাক-মুখ। সেই তালপাতের উপর জামাজোড়া পরা। তাহার শরীর দেখিয়া কঙ্কাবতী অতিশয় বিস্মিত হইলেন।

 কঙ্কাবতী জিজ্ঞাসা করিলেন,— “তুমি কে?”

 লোকটি উত্তর করিল,— “আমি আকাশের দুর্দ্দান্ত সিপাহী। আবার কে? এখন ছাড়িয়া দাও, বাড়ী যাই। আঙ্গুল দিয়া অমন করিয়া টিপিও না।”

 কঙ্কাবতী জিজ্ঞাসা করিলেন,— “তোমার শরীর তালপাতা দিয়া গড়া?”

 দুর্দ্দান্ত সিপাহী বলিলেন,— “তালপাতা দিয়া গড়া হইবে না তো কি দিয়া গড়া হইবে? ইট-পাথর চুণ-সুরকি দিয়া রেক্তার গাঁথুনি করিয়া আমার শরীর গড়া হবে না কি? এত দেশ বেড়াইলে, এতকাণ্ড করিলে, আর তালপাতার সিপাহীর নাম কখনও শুননি? এই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডে আমাকে কে না জানে? বীরপুরুষ দেখিলেই লোকে আমার সহিত উপমা দেয়। এখন ছাড়িয়া দাও, বাড়ী যাই। ভাল এক মূল-শিকড় কাটাকাটি হইয়াছে বটে!”

 কঙ্কাবতী এখন বুঝিলেন যে, ছেলেবেলা তিনি যে সেই তালপাতার সিপাহীর কথা শুনিয়াছিলেন, তাহার বাস আকাশে, পৃথিবীতে নয়। আর সেই-ই আকাশের দুর্দ্দান্ত সিপাহী।

১২০
ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ