পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/১৫১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

উঠিল। অতি ক্লেশে মাঝিরা নৌকা চালাইতে লাগিল। ঝড় ও তুফান ক্রমেই বাড়িতে লাগিল। আর অগ্রসর হইতে না পারিয়া মাঝিরা একস্থানে নৌকা লাগাইল। সে স্থানে তিনখানি বড় নৌকা বাঁধা ছিল। ক্রমে সন্ধ্যা হইল, ক্রমে রাত্রি হইল, বায়ু ও ঢেউ ক্রমেই বাড়িতে লাগিল। একখানি চাদর মুড়ি দিয়া নিধিরাম নৌকার ভিতর শুইয়া হিরণ্ময়ীর রূপ মনে মনে ধ্যান করিতে লাগিলেন। অল্পক্ষণ পরেই তিনি নিদ্রায় অভিভূত হইয়া পড়িলেন। কতক্ষণ নিদ্রিত ছিলেন, তাহা ঠিক বলিতে পারেন না। হঠাৎ তিনি জাগরিত হইলেন। জাগরিত হইয়া দেখিলেন যে, তুমুল ঝড় উঠিয়াছে। নিবিড় অন্ধকার, কোলের মানুষ দেখা যায় না। ঝড় ও তরঙ্গের শব্দে কানে তালা লাগে। ছাঁইয়ের ভিতর হইতে যেই একটু মুখ বাহির করিয়াছেন, আর জলের ঝাপটা তাঁহার মুখে লাগিল। বারিকণাগুলি যেন সূচের মত তাহার মুখে বিঁধিয়া যাইল। মাঝিরা বলিল, “মহাশয়! এরূপ ঝড়-তুফান তো কখন দেখি নাই। বাতাস এখন উত্তরে হইয়াছে, আমরা নদীর উত্তর ধারে রহিয়াছি। নৌকা রাখা ভার হইয়াছে।”

 নিধিরাম একবার ভাবিলেন,— “নৌকা হইতে উঠিয়া গ্রামে গিয়া আশ্রয় লই।” কিন্তু দিনের বেলা। তিনি দেখিয়াছিলেন যে, নদীর উপরেই প্রায় একক্রোশ মাঠ, তাহার পর গ্রাম; সে অন্ধকারে, সে প্রবল ঝড়ে, সে জলের ঝাপটে, একক্রোশ মাঠ পার হইয়া গ্রামে যায় কার সাধ্য? তাই তিনি নৌকাতেই বসিয়া রহিলেন! ঝড়ের বেগে পটপট করিয়া নৌকার কাছি ছিড়িতে লাগিল, লগি উঠিয়া পড়িতে লাগিল। সকলের ভয় হইল, কাছি ছিঁড়িয়া নৌকা পাছে নদীর মাঝখানে চলিয়া যায়। যতবার কাছি ছিঁড়িয়া যায়, মাঝিরা ততবার কাছি বাঁধিয়া দেয়, যতবার লাগি উঠিয়া পড়ে, মাঝিরা ততবার পুনরায় পুঁতিয়া দেয়। নিধিরামও মাঝিদিগের বিশেষ সহায়তা করিতে লাগিলেন। বড় নৌকাগুলির ছিড়িয়া একে একে নদীমধ্যে চলিয়া গেল। অন্ধকারে ভালরূপ কিছু দেখিবার যো ছিল না। ঝড়ের শব্দের মাঝখানে একটু মনুষ্য- কোলাহল শব্দ পান, চাহিয়া দেখেন, বড় নৌকার আলোটি মাঝখানের দিকে যাইতেছে। মুহূর্ত্তমধ্যে নৌকার লণ্ঠনের আলোটি নিবিয়া যায়। মাঝিরা বলে,— “মহাশয়, ঐ একখানি নৌকা ডুবিয়া গেল।” এইরূপে একে একে দুইখানি বড় নৌকা নদীর মাঝখানে গিয়া ডুবিয়া গেল। কেবল একখানি বড় নৌকা রহিল। নদীর উচ্চ পাড়ের নীচে নিধিরামের নৌকা ছিল। তাঁহার নৌকাখানি ছোট, সে জন্য ঝড়ের প্রবল বেগ সম্পূর্ণভাবে তাঁহার নৌকায় লাগিতেছিল না। তাঁহার নৌকাখানি হয়তো বাঁচিয়া যাইবে, নিধিরামের এই একটু ভরসা ছিল।

 কিন্তু সে ভরসা মিথ্যা হইল। অবশিষ্ট বড় নৌকাখানি কাছি ছিঁড়িয়া, তাহার নৌকার উপর আসিয়া পড়িল। তাঁহার নৌকার হালটি উচ্চভাবে ছিল। বড় নৌকার লোকেরা সেই হালটি ধরিয়া ফেলিল। নিধিরামের নৌকার সমস্ত কাছিগুলি তৎক্ষণাৎ ছিড়িয়া গেল। দুইখানি নৌকাই তীরের মত নদীর মাঝখানে দৌঁড়িল। অল্পক্ষণ মধ্যেই দুইখানি নৌকা ছাড়াছাড়ি হইয়া গেল। বড় নৌকাখানি ডুবিয়া গেল। নিধিরামের নৌকাখানিও জলমগ্ন হইল। নিধিরাম নদীর মাঝখানে ভাসিতে লাগিলেন। সাঁতার তিনি উত্তমরূপে জানিতেন। কিন্তু পর্ব্বতপ্রমাণ ঢেউ, ঘোর অন্ধকার, দিকের ঠিক নাই। কাহার সাধ্য সাঁতার দেয়, আর সাঁতার দিয়াই বা কোনদিকে যাইবেন? অল্প অল্প হাত-পা নাড়িয়া তিনি কেবল ভাসিয়া থাকিতে চেষ্টা করিতে লাগিলেন। কিন্তু ভাসিয়া থাকাও দুঃসাধ্য কথা। পর্ব্বতসদৃশ তরঙ্গরাশি তৃণবৎ তাঁহাকে তুলিতে-ফেলিতে লাগিল। ঢেউয়ের আঘাতে তা তাঁহার শরীর চূর্ণ-বিচূর্ণ হইতে লাগিল। একবার তরঙ্গের শিখরদেশে উঠিয়া যখন তিনি পুনরায় নামিতে থাকেন, সেই সময়ে ঢেউয়ের মাথাটি ভাঙ্গিয়া

ভূত ও মানুষ
১৪১