পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/৫০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 জনার্দ্দন চৌধুরী বলিলেন,— “না না! খেতার সহিত গদাধরের কি কি কথা হইয়াছিল, আমি সমস্ত শুনিতে চাই। ছোঁড়া যে গদাধরকে এত কথা জিজ্ঞাসা করিল, তাহার অবশ্যই কোনও না কোনও দুরভিসন্ধি থাকিবে। গদাধর! তাহার পর কি হইল, বল।”

 গদাধর পুনরায় বলিতেছে,— “খেতু আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন যে, ব্রাহ্মণ মারিতে কষ্ট হইয়াছিল কেন?' আমি বলিলাম,— 'দাদাঠাকুর, কোথা হইতে একবার তিনজন ব্রাহ্মণ আমাদের গ্রামে গরদের কাপড় বেচিতে আসেন। গ্রামে তাহারা থাকিবার স্থান পাইতেছিলেন না। বাসার অন্বেষণে পথে পথে ফিরিতেছিলেন। আমার সঙ্গে পথে দেখা হইল। একটি পাতা হাতে করিয়া আমি তখন ব্রাহ্মণের পদধূলি আনিতে যাইতেছিলাম। প্রত্যহ ব্রাহ্মণের পদধূলি না খাইয়া আমি কখনও জলগ্রহণ করি না। ব্রাহ্মণ দেখিয়া আমি সেই পাতায় তাঁহাদের পদধূলি লইলাম, আর বলিলাম,— 'আসুন আমার বাড়ীতে, আপনাদিগকে বাসা দিব।' তাহারা আমার বাড়ীতে বাসা লইলেন। আমাদের গ্রামে তিন দিন রহিলেন, অনেকগুলি কাপড় বেচিলেন, অনেক টাকা পাইলেন। আমি সেই সন্ধান কমলকে দিলাম। কমলেতে আমাতে পরামর্শ করিলাম যে, তিনটিকে সাবাড়া করিতে হইবে।' দলস্থ অন্য কাহাকেও কিছু বলিলাম না, কারণ, তাহা হইলে ভাগ দিতে হইবে। কমলকে বলিলাম,— 'তুমি আগে গিয়া মাঠের মাঝখানে লুকাইয়া থাক। অতি প্রত্যুষে ইহাদিগকে আমি সঙ্গে লইয়া যাইব। দুই জনেই সেইখানে কার্য্য সমাধা করিব।” তাহার পরদিন প্রত্যুষে আমি সেই তিন জন ব্রাহ্মণকে পথ দেখাইবার জন্য লইয়া চলিলাম! ভগবানের এমনি কৃপায় যে, সেদিন ঘোর কোয়াসা হইয়াছিল, কোলের মানুষ দেখা যায় না। নির্দ্দষ্ট স্থানে উপস্থিত হইবামাত্র কমল বাহির হইয়া একজনের মাথায় লাঠি মারিলেন। আমিও সেই সময় আর একজনের মাথায় লাঠি মারিলাম। তাঁরা দুই জনেই পড়িয়া গেলেন। আমরা সেই দুই জনকে শেষ করিতেছি, এমন সময় তৃতীয় ব্রাহ্মণটি পলাইলেন। কমল তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ দৌঁড়িলেন, আমিও আমার কাজটি সমাধা করিয়া তাঁহাদিগের পশ্চাৎ দৌঁড়িলাম। ব্রাহ্মণ গ্রামের ভিতর প্রবেশ করিলেন। শিরোমণি মহাশয়ের বাটীতে গিয়া,— 'ব্রহ্মহত্যা হয়! প্রাণ রক্ষা করুন', —এই বলিয়া আশ্রয় লইলেন। অতি স্নেহের সহিত শিরোমণি মহাশয় তাহাকে কোলে করিয়া লইলেন। শিরোমণি মহাশয় তাহাকে মধুর বচনে বলিলেন,— 'জীবন ক্ষণভঙ্গুর! পদ্মপত্রের উপর জলের ন্যায়। সে জীবনের জন্য এত কাতর কেন বাপু?' এই বলিয়া ব্রাহ্মণকে পাঁজা করিয়া বাটীর বাহিরে দিয়া শিরোমণি মহাশয় ঝনাৎ করিয়া বাটীর দ্বারটি বন্ধ করিয়া দিলেন। কমল পুনরায় ব্রাহ্মণকে মাঠের দিকে তাড়াইয়া লইয়া চলিলেন। ব্রাহ্মণ যখন দেখিলেন যে, আর রক্ষা নাই, কমল তাঁহাকে ধর-ধর হইয়াছেন, তখন তিনি হঠাৎ ফিরিয়া কমলকে ধরিলেন। কিছুক্ষণের নিমিত্ত দুই জনে হুটাহুটি হইল। হাতীর মত কমলের শরীরে বল, কমলকে তিনি পরিবেন কেন? কমল তাঁহাকে মাটিতে ফেলিয়া দিলেন, তাঁহার বুকের উপর চড়িয়া বসিলেন, তাঁহার নাতিকুণ্ডলে পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি বসাইয়া তাঁহাকে মারিয়া ফেলিতে চেষ্টা করিতে লাগিলেন। কিন্তু সেই ব্রাহ্মণ-দেবতার এমনি কঠিন প্রাণ যে, তিনি অজ্ঞানও হন না, মরেনও না। ক্রমাগত কেবল এই বলিয়া চীৎকার করিতে লাগিলেন,— 'হে মধুসূদন! আমাকে রক্ষা কর! হে মধুসূদন! আমাকে রক্ষা কর! বাপসকল! ব্রহ্মহত্যা হয়! কে কোথা আছ? আসিয়া আমার প্রাণরক্ষা কর!' আমি পশ্চাতে পড়িয়াছিলাম। কোনদিকে ব্রাহ্মণ পলাইয়াছেন, আর কমল বা কোনদিকে গিয়াছেন, কোয়াসার জন্য তাহা আমি দেখিতে পাই নাই। এখন ব্রাহ্মণের চীৎকার শুনিয়া আমি সেইদিকে দৌঁড়িলাম। গিয়া দেখি, ব্রাহ্মণ মাটিতে পড়িয়া রহিয়াছেন, কমল তাঁহার বুকের উপরে, কমল

৩৮
ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ