পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/৭৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

খুলিয়া দিবেন?' সেই গৰ্জ্জনের ভিতর হইতেও একটু যেন বুঝিলাম যে, সে কাহার কণ্ঠস্বর। তারপর আবার, ঘরের ভিতর আসিয়া, যখন তুমি চুপি-চুপি মা'র কানে ও আমার কানে বলিলে,— 'কোনও ভয় নাই’। তখন তো নিশ্চয়ই বুঝিলাম যে, তুমি বাঘ নও।”

 খেতু বলিলেন,— “অনেক দুঃখ গিয়াছে। কঙ্কাবতী! তুমিও অনেক দুঃখ পাইয়াছ, আমিও অনেক দুঃখ পাইয়াছি। আর একবৎসরকাল দুঃখ সহিয়া এইখানে থাকিতে হইবে। তাহার পর ঈশ্বর যদি কৃপা করেন, তো আমাদের সুখের দিন আসিবে। দেখিতে দেখিতে একবৎসরকাল কাটিয়া যাইবে। তখন এই সমুদয় ঐশ্বর্য্য আমাদের হইবে। আহা! মা নাই, এত ধন লইয়া যে কি করিব? তাই ভাবি, মা যদি বাঁচিয়া থাকিতেন, তাহা হইলে পৃথিবীতে যাহা কিছু পুণ্যকর্ম্ম আছে, সমস্ত আমি মাকে করাইতাম। যাহা হউক, পৃথিবীতে অনেক দীন-দুঃখী আছে। কঙ্কাবতী! এখন কেবল তুমি আর আমি। যতদূর পারি, দুইজনে জগতের দুঃখ মোচন করিয়া জীবন অতিবাহিত করিব।”

 কঙ্কাবতী জিজ্ঞাসা করিলেন,— “মাতার সৎকারকার্য্য সমাপ্ত করিয়া আমাকে বাটীতে রাখিয়া, তাহার পর তুমি কোথায় যাইলে? কি করিলে? ফিরিয়া আসিতে তোমার একবৎসরের অধিক হইল কেন? তুমি ব্যাঘ্রের আকার ধরিলে কেন? সে সব কথা তুমি আমাকে এখন বলিবে না?”

 খেতু বলিলেন,— “না, কঙ্কাবতী! এখন নয়। একবৎসর গত হইয়া যাক, তাহার পর সব কথা তোমাকে বলিব।”

 কঙ্কাবতী আর কোনও কথা জিজ্ঞাসা করিলেন না। কঙ্কাবতী ও খেতু, পর্ব্বত-অভ্যন্তরে সেই অট্টালিকায় বাস করিতে লাগিলেন। অট্টালিকায় কোনও দ্রব্য কঙ্কাবতী স্পর্শ করেন না। কেবল খেতু যাহা হাতে করিয়া দেন, তাহাই গ্রহণ করেন।

 অট্টালিকার ভিতর সমুদয় দ্রব্য ছিল, কেবল খাদ্যসামগ্রী ছিল না। প্রতিদিন বাহিরে যাইয়া খেতু বনের ফলমূল লইয়া আসেন, তাহাই দুইজনে আহার করিয়া কালযাপন করেন! বাহিরে যাইতে হইলে, খেতু ব্যাঘ্ররূপ ধারণ করেন। বাঘ না হইয়া খেতু কখনও বাহিরে যান না। আবার অট্টালিকার ভিতর আসিয়া খেতু পুনরায় মনুষ্য হন। কেন তিনি ব্যাঘ্রের রূপ না ধরিয়া বাহিরে যান না, কঙ্কাবতী তাহা বুঝিতে পারেন না। খেতু মানা করিয়াছেন, সেজন্য জিজ্ঞাসা করিবারও যো নাই! এইরূপে দশ মাস কাটিয়া গেল।

 একদিন কঙ্কাবতী বলিলেন,— “অনেকদিন মাকে দেখি নাই। মাকে দেখিতে বড় ইচ্ছা! হয়, মা'ও আমাদের কোনও সংবাদ পান নাই; মা’ও হয় তো চিন্তিত আছেন। আমরা কোথায় যাইলাম, কি করিলাম, মা তাহার কিছুই জানেন না।”

 খেতু উত্তর করিলেন,— “অল্পদিনের মধ্যে পুনরায় দেশে যাইব, সেজন্য আর তাহাদিগকে কোনও সংবাদ দিই নাই। আর লোকালয়ে যাইতে হইলেই আমাকে বাঘ হইয়া যাইতে হইবে, সেজন্য আর যাইতে বড় ইচ্ছাও হয় না। কি জানি কখন কি বিপদ ঘটে, বলিতে তো পারা যায় না। যাহা হউক, মাকে দেখিতে যখন তোমার সাধ হইয়াছে, তখন কা’ল তোমার এ সাধ পূর্ণ করিব। কাল সন্ধ্যার সময় মা'র নিকট তোমাকে আমি লইয়া যাইব। কঙ্কাবতী! বৎসর পূর্ণ হইতে আর কেবল দুই মাস আছে; যদি তোমার ইচ্ছা হয়, তাহা হইলে এই দুই মাস তুমি না হয়, বাপের বাড়ী থাকিও।”

 কঙ্কাবতী বলিলেন,— “না, তা আমি থাকিতে চাই না! তুমি এই বনের ভিতর নানা বিপদের মধ্যে একেলা থাকিবে, আর আমি বাপের বাড়ী থাকিব, তা' কি কখনও হয়? মা'র জন্য মন উতলা হইয়াছে— কেবল একবারখানি মাকে দেখিতে চাই। দেখাশুনা করিয়া আবার তখন ফিরিয়া আসিব।”