পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

আত্মীয়ের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করেন। যেখানে এসে তাঁর টাকা-পয়সা ফুরিয়ে যায়, সেখান থেকে তার গন্তব্য বনজঙ্গল-পর্বতময় এলাকা দিয়ে তিন দিনের হাঁটাপথ। তিনি হাঁটতে থাকলেন। পথে এক কুলি-সরবরাহকারীর পাল্লায় পড়েন। কুলির দল নিয়ে সে-ব্যক্তি যখন যাত্রা করেন, তখন পথের মধ্যে ত্রৈলোক্যনাথ পালিয়ে যান এবং কেবল বন্য কুল খেয়ে পদব্রজে মানভূমে পৌঁছোন।

 তাঁর আত্মীয় তাকে স্কুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। ঘটনাক্রমে সে-সময়ে স্কুলের প্রথম শ্রেণীর ছাত্রেরা কর্তৃপক্ষের নির্দেশে রাচিতে মেলা দেখতে যায়। ত্রৈলোক্যনাথ তাদের সঙ্গ নেন। রাচি পাঁচ দিনের পথ। পথে তিনি এত রকম উৎপাত করতে থাকেন যে, দলের অভিভাবকেরা তার ওপরে খুব বিরক্ত হন। রাঁচি পৌঁছে দল ছেড়ে একাই তিনি বনের পথে হাঁটতে থাকেন। পথে তস্করেরা তাঁর পরিধেয় বস্ত্র কেড়ে নেয়। তবু তিনি আবার রাঁচি হয়ে মানভূমে ফিরে আসতে সমর্থ হন। এখানে এক মৌলভির কাছে ভালো করে ফারসি শেখেন।

 এরপর হঠাৎ করে তিনি স্বগ্রামে ফিরে আসেন। তারপর ইছাপুরে, যশোরের কোটচাঁদপুরে, বর্ধমানে, কাটোয়ায়, বীরভূমের কীর্ণহারে, রামপুরহাটে হয় চাকরি করেন কিংবা চাকরির উমেদারিতে সকল সঞ্চয় ব্যয় করেন। যাত্রাপথে অপরিচিত গৃহস্থের অতিথি হয়ে থাকতেন। কিছুকাল পর তিনি বীরভূমের দ্বারকায় স্কুলশিক্ষক নিযুক্ত হন, সেখান থেকে রানীগঞ্জের উখড়া স্কুলে যান দ্বিতীয় শিক্ষক হয়ে। তখন তার বেতন যৎসামান্য, কিন্তু দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষকে যথাসর্বস্ব দিয়ে সাহায্য করতে তিনি পিছপা হন নি। এ-সময়েই তিনি সঙ্কল্প করেন যে, দেশে দুর্ভিক্ষনিবারণের কাজে আত্মনিয়োগ করবেন।

 দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর পাবনার সাহজাদপুরে নিজের জমিদারিতে তাকে স্কুলশিক্ষক নিযুক্ত করেন, বেতন পঁচিশ টাকা। একবার ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে তাঁর প্রাণসংশয় হয়েছিল। অজ্ঞান অবস্থায় তাকে রক্ষা করে এক চণ্ডাল পরিবার। চৈতন্য ফিরে পেয়ে তিনি নিঃস্ব অবস্থায় পাবনায় ফিরে আসেন। সেখানে নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্রের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা হয়। পাবনায় কর্মরত এক ইনজিনিয়ার তাকে কাপড়াচোপড় কিনে দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেন।

 এবারে কর্মের সন্ধানে কটক-যাত্রা—হেঁটে ও সাঁতরে। পথে নুন ও লঙ্কা দিয়ে চিঁড়ে খেয়ে কাটান। কটকে এসে পুলিশের সাব-ইনস্পেক্টর পদে নিয়োগলাভ করেন। এই পদে থাকতে তিনি নানা জায়গায় ভ্রমণ করেন, ওড়িয়া ভাষা শেখেন এবং ওড়িয়ায় একটি মাসিকপত্র সম্পাদন করেন। কটকে থাকতে বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে: কবি ও ডেপুটি কালেকটর রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, লেখক ও সাব-জজ গঙ্গাচরণ সরকার, বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ও সরকারি কর্মকর্তা স্যার উইলিয়াম হাণ্টার। হাণ্টার কী এক কাজে কটকে এসেছিলেন, সেখানেই পরিচয়; কলকাতায় ফিরে গিয়ে তিনি নিজের অফিসে ত্রৈলোক্যনাথকে ১২৫ টাকার মাসিক বেতনে চাকরি দেন