পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২০৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

মেয়ে, দুই মামা, একটি চীনে এবং জন-দুই মাদ্রাজী মুসলমান মিলে এঁরা জাভায় লুকানো আফিঙ গাঁজা আমদানি-রপ্তানীর ব্যবসা করতেন। তখনও কিছুই জানিনে কি করেন, শুধু দেখতে পেতাম বাটাভিয়া থেকে সুরাভায়ার পথে রেল গাড়িতে সুমিত্রাকে প্রায়ই যাওয়া-আসা করতে। অতিশয় সুশ্রী বলে অনেকের মত আমারও দৃষ্টি পড়েছিল। এই পর্য্যন্তই। কিন্তু হঠাৎ একদিন পরিচয় হয়ে গেল তেগ স্টেশনের ওয়েটিংরুমে। বাঙালীর মেয়ে বলে তখনই কেবল প্রথম খবর পেলাম।

 ভারতী বলিল, সুন্দরী বলে আর সুমিত্রাদিদিকে ভুলতে পারলে না—দাদা?

 ডাক্তার কহিলেন, সে যাই হোক, একদিন জাভা ছেড়ে কোথায় চলে গেলাম ভারতী, বোধ হয় ভুলেও গিয়েছিলাম,—কিন্তু বছর খানেক পরে অকস্মাৎ বেঙকুলান শহরের জেটিতে দেখা সাক্ষাৎ। এক তোরঙ্গ আফিঙ, চারিদিকে পুলিশ আর তার মাঝে সুমিত্রা। আমাকে দেখে চোখ দিয়ে তার জল পড়তে লাগলো, এ সন্দেহ আর রইল না যে আমাকে তাকে বাঁচাতেই হবে। আফিঙের সিন্ধুকটাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে একেবারে স্ত্রী বলে তার পরিচয় দিলাম। এতটা সে ভাবেনি, সুমিত্রা চমকে গেল। সুমাত্রার ঘটনা বলে সুমিত্রা নামটাও আমারই দেওয়া। নইলে তার সাবেক নাম ছিল, রোজ দাউদ। তখন বেঙকুলানের মামলা-মকদ্দমা পাদাঙ শহরে হোতো, আমার একজন পরম বন্ধু ছিলেন পল ক্রুগার, তাঁর বাড়িতে সুমিত্রাকে নিয়ে এলাম। মামলায় ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব সুমিত্রাকে খালাস দিলেন বটে, কিন্তু সুমিত্রা আর আমাকে খালাস দিতে চাইলে না।

 ভারতী হাসিয়া কহিল, খালাস কোনদিন পাবেও না দাদা।

 ডাক্তার কহিতে লাগিলেন, ক্রমশঃ তাদের দলের লোক খবর পেয়ে উঁকি-ঝুঁকি মারতে লাগলো, বন্ধু ক্রুগারও দেখতে পেলাম সৌন্দর্য্যে চঞ্চল হয়ে উঠছেন, অতএব তাঁর জিম্মাতে রেখেই একদিন চুপি চুপি সুমাত্রা ছেড়ে সরে পড়লাম।

 ভারতী আশ্চর্য্য হইয়া বলিল, এদের মাঝে তাঁকে একলা ফেলে রেখে? উঃ,—তুমি কি নিষ্ঠুর দাদা!

 ডাক্তার বলিলেন, হাঁ, অনেকটা অপূর্ব্বর মত। আবার বছর খানেক কেটে গেল। তখন সেলিবিস দ্বীপে ম্যাকেসার শহরে একটি ছোট্ট অখ্যাত হোটেলে বাস করছিলাম, একদিন সন্ধ্যার সময় ঘরে ঢুকে দেখি সুমিত্রা বসে। তার পরণে হিন্দু মেয়েদের মত তসরের শাড়ি আর এই প্রথম আজ আমাকে সে হিন্দু মেয়ের মতই হেঁট হয়ে প্রণাম করে উঠে দাঁড়াল। বললে, আমি সমস্ত ছেড়ে চলে এসেচি, সমস্ত অতীত মুছে ফেলে দিয়েছি, আমাকে তোমার কাজে ভর্ত্তি করে নাও, আমার চেয়ে বিশ্বস্ত অনুচর তুমি আর পাবে না।

২০৫