“বাঙ্গলাবাজার” এই নগরের পূর্ব্বতন নামের স্মৃতি বহন করিতেছে। এখনও যে “বাঙ্গালো” বা “বাঙ্গলা” ঘর আমরা এদেশে সর্ব্বত্র দেখিতে পাই, তাহারও উৎপত্তি স্থান সেই প্রাচীন রাজধানীতে।
কিন্তু এখানে “বারবাঙ্গালা” বলিতে ঘর বোঝায় নাই। বাঙ্গালাদেশ দ্বাদশ খণ্ডে বিভক্ত ছিল এবং এক সময়ে এই “দ্বাদশ” স্থানের অধিপতি দ্বাদশটি ক্ষুদ্র রাজা ছিলেন, ইঁহাদের উপাধি ছিল “বারভুঞা”—এইরূপ দ্বাদশ ভাগে একটা প্রধান দেশকে বিভক্ত করার রীতি প্রাচীন কালে আর্য্যগণঅধুষিত বহু প্রদেশে প্রচলিত ছিল। গ্রীক্দিগের “ডডনপ্লাস” বারভুঞারই নামান্তর। রাজপুতনার কোন কোন স্থানে এখনও রাজার অধীনে দ্বাদশ মণ্ডল বা দ্বাদশ প্রধান নায়ক থাকার রীতি বিদ্যমান। ত্রিপুরার রাজা স্বীয় অভিষেকের সময় দ্বাদশটি সামন্ত রাজা নিযুক্ত করিতেন। এই রীতি আর্য্যগণশাসিত রাজ্যসমূহের একটি অতি পুরাতন প্রথা। ‘বারভূঞা’র উল্লেখ আমরা ধর্ম্মমঙ্গল এবং বহুবিধ বাঙ্গালা প্রাচীন কাব্যে পাই। ধর্ম্মমঙ্গলে লিখিত আছে যে কোন রাজচক্রবর্ত্তীর অভিষেকের সময় বারভুঞা বা বার জন “ভুঞা রাজা” তাঁহার মস্তকে অভিষেকের বারি বর্ষণ করিতেন। সুতরাং ইহা মনে করিতে হইবে না যে প্রতাপাদিত্য-ইশা খাঁ-প্রমুখ বারভুঞারাই মাত্র বাঙ্গালার ‘বারভুঞা’-পদবাচ্য। ইঁহাদের পূর্ব্ববর্ত্তী বহু “বারভুঞা” এ দেশ শাসন করিয়া গিয়াছেন। “ভূঞা” শব্দ ভৌমিক শব্দের অপভ্রংশ, সুতরাং ইহা খাঁটি হিন্দুরাজ্যের সময়কার নিদর্শন, মুসলমান-অধিকারে এই উপাধির সৃষ্টি হয় নাই।
এখানে “বারবাঙ্গালা” বলিতে দ্বাদশ ভৌমিক-শাসিত সমস্ত রাজ্যটি বুঝাইতেছে। কিন্তু এই পালাগানটিতে কথাটির কোন ঐতিহাসিক সার্থকতা, নাই। সুজার সময় এই প্রতিষ্ঠানটি উল্লেখযােগ্যভাবে আর বাঙ্গালায় বিদ্যমান ছিল না। কথাটা বহু প্রাচীন সংস্কারাগত এবং এক সময়ে বঙ্গদেশে যে দ্বাদশ জন পরাক্রান্ত দেশনায়ক ছিলেন—তাহারই ক্ষীণ স্মৃতির পরিচায়ক।
২রা সেপ্টেম্বর, ১৯৩১