বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:প্রবাসী (দ্বাত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৭৮১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পত্রধারা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যার ধ্যান আমার চিত্তের অবলম্বন শাস্ত্ৰমতে র্তাকে কী সংজ্ঞা দেওয়া যায় জিজ্ঞাসা করেচ । সহজে বোঝাতে পারব না, উপলব্ধির জিনিষকে ব্যাখ্যা দ্বারা স্পষ্ট করা যায় না। তোমার প্রশ্ন এই, তিনি কি সৰ্ব্বমানবের সমষ্টি । সমষ্টি কথাটায় ভুল বোঝার আশঙ্ক আছে। এক বস্তা আলুকে আলুর সমষ্টি যদি বল তবে সে হল আর এক কথা। মামুষের সজীব দেহ লক্ষকোটি জীবকোষের সমষ্টি, কিন্তু সমগ্র মাস্তব জ্ঞানে প্রেমে কৰ্ম্মে আত্মাহুভূতিতে জীবকোষসমষ্টির চেয়ে অসীম গুণে বড়ো। ব্যক্তিগত মানব মহামানব থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, তারি মধ্যেই তার জন্ম ও বিলয় কিন্তু তাই ব’লে সে তার সমান হতে পারে না। ব্যক্তিগত মানব মহামানবকে উপলব্ধি ক’রে আনন্দিত হয়, মহিমা লাভ করে যখন সে নিজের ভোগ নিজের স্বার্থকে বিশ্বত হয়, যখন তার কৰ্ম্ম তার চিন্তা মরণধৰ্ম্মী জীবলীলাকে পেরিয়ে যায়, যখন তার ত্যাগ তার প্রয়াস স্বদুর দেশ স্বদূর কালকে আশ্রয় করে, তার আত্মীয়তার বোধ সঙ্কীর্ণ সমাজের মধ্যে খণ্ডিত হয়ে না থাকে। এই বোধের দ্বারা আমরা এমন একটি সত্তাকে অন্তরতমরূপে অহুভব করি যা আমার ব্যক্তিগত পরিধিকে উত্তীর্ণ করে পরিব্যাপ্ত। তখন সেই মহাপ্রাণের জন্যে মহাত্মার জন্যে নিজের প্রাণ ও আত্মস্বথকে আনন্দে নিবেদন করতে পারি। অর্থাৎ তখন আমি যে-জীবনে জীবিত সে-জীবন আমার আয়ুর দ্বারা পরিমিত নয়। এই জীবন কার ? সেই পুরুষের, যিনি সকলের মধ্যে ও সকলকে অতিক্রম ক’রে, উপনিষদ যার কথা বলেচেন “তং বেদ্যং পুরুষং বেদ যথা মা বো মৃত্যু: পরিব্যথাঃ ” কেবলমাত্র জপতপ পূজাচ্চনা করে তার উপলব্ধি নয়, মাহুষের যে-কোনো প্রকাশে মহিমা আছে, বিজ্ঞানে দর্শনে শিল্পে সাহিত্যে ; অর্থাৎ যাতে সে এমন কিছুকে প্রকাশ করে যার মধ্যে পূর্ণতার সাধনা। এ সমস্তই মানুষের সম্পদ, ক্ষণজীবী পণ্ডমামুষের নয়, কিন্তু সেই চিরমানবের, ইতিহাস র্যার মধ্যে দিয়ে ক্রমাগতই বর্বরতার প্রাদেশিকতার সাম্প্রদায়িকতার বন্ধন কাটিয়ে সৰ্ব্বজনীন সত্যরূপকে উদঘাটিত করচে। সকল ধৰ্ম্মেই র্যাকে সৰ্ব্বোচ্চ ব’লে ঘোষণা করে তার মধ্যে মানবধর্শেরই পূর্ণতা—মাষ্ট্য ধা-কিছুকে কল্যাণের মহৎ আদর্শ বলে মানে তারই উৎস যার মধ্যে । নক্ষত্ৰলোকে মানবের রূপ নেই মানবের গুণ নেই, সেখানে কেবল বিশ্বশক্তির নৈর্ব্যক্তিক বিকাশ, বিজ্ঞান তাকে সন্ধান করে, কিন্তু মানুষের প্রেমভক্তির স্থান সেখানে নেই। মহাপুরুষেরা সেই নিত্য মানবকেই একান্ত আনন্দের সঙ্গেই অস্তরে দেখেচেন, কিন্তু বারে বারে তাকে নানা নামে, নানা আখ্যানে, নানা রূপ কল্পনায় দূরে ফেলা হয়েচে, এমন কি অনেক সময় মানুষ র্তাকে নিজের চেয়েও ছোট করেচে—এবং ভুমার সাধনাকে সঙ্কীর্ণক্ষেত্রে আধ্যাত্মিক ভোগবিলাসের সামগ্রী করে তুলেচে। তুমি প্রশ্ন করেচ বলেই এত কথা বললুম, নতুবা তর্ক করে তোমাকে পীড়া দিতে আমি ইচ্ছা করিনে। সত্য যদি নিতান্তই আত্মতৃপ্তির উপকরণ মাত্র হত তবে যে অভ্যাসের মধ্যে যে স্থখ পায় তাই নিয়েই তাকে থাকতে বলা যেত। সত্যের সঙ্গে ব্যবহারে তৃপ্তি গৌণ, মুক্তি মুখ্য—যে ক্ষুদ্রতার আবরণ থেকে মুক্তি হলে নিজেদের স্পষ্ট করে জানি অমৃতস্ত পুত্রাঃ সেই মুক্তি-তার সাধনায় দুঃখ আছে । আমর দ্বিজ, একটা জন্ম পশুলোকে, আর একটা জন্ম মানবলোকে, এই দ্বিতীয় জন্মের জনেই প্রার্থনা করি আসতো ম{ সদগময়। ইতি ২১ জুলাই ১৯৩১ ।