দেবী চৌধুরাণী ভ। ক্ষতি নাই। কিন্তু সম্প্রতি অনেকগুলি লোক দারিদ্র্যগ্রস্ত—ইজারাদারের দৌরাত্ম্যে সৰ্ব্বস্ব গিয়াছে । এখন কিছু কিছু পাইলেই তাহার। আহার করিয়া গায়ে বল পায় । গায়ে বল পাইলেই তাহারা লাঠিৰাজি করিয়া আপন আপন স্বত্ব উদ্ধার করিতে পারে । শীঘ্র এক দিন দরবার করিয়া তাহাদিগকে রক্ষা কর । দে। তবে প্রচার করুন যে, এইখানেই আগামী সোমবার দরবার হইবে । ভ। না । এখানে আর তোমার থাকা হইবে না। ইংরেজ সন্ধান পাইয়াছে, তুমি এখন এই প্রদেশে আছ । এবার পাচ শত সিপাহী লইয়৷ তোমার সন্ধানে আসিতেছে । অতএব এখানে দরবার হইবে না। বৈকুণ্ঠপুরের জঙ্গলে দরবার হুইবে, প্রচার করিয়াছি । সোমবার দিন অবধারিত করিয়াছি । সে জঙ্গলে সিপাহী যাইতে সাহস করিবে না-করিলে মারা পড়িবে। ইচ্ছামত টাকা সঙ্গে লইয়। আজই বৈকুণ্ঠপুরের জঙ্গলে যাত্রা কর । দে ৷ এবার চলিলাম। কিন্তু আর আমি এ কাজ করিব কি না সন্দেহ । ইহাতে আর আমার মন নাই। এই বলিয়া দেবী উঠিল। আবার জঙ্গল ভাঙ্গিয়া বজরায় গিয়া উঠিল। বজরায় উঠিয়া রঙ্গরাজকে ডাকিয়া চুপি চুপি এই উপদেশ দিল, “আগামী সোমবার বৈকুণ্ঠপুরের জঙ্গলে দরবার হইবে । এই দণ্ডে বজরা খোল—সেইখানেই চল—বরকন্দাজদিগের সংবাদ দাও, দেবীগড় হুইয়া যাইও–টাকা লইয়া যাইতে হুইবে । সঙ্গে অধিক টাকা নাই ।” তখন মুহূৰ্ত্তমধ্যে বজরার মাস্তুলের উপর তিন চারিখানা ছোট বড় সাদা পাল বাতাসে ফুলিতে লাগিল ; ছিপখান বজরার সামনে ত্যাসিয়া বজরার সঙ্গে বাধা হইল । তাহাতে ষাট জন জোয়ান বোটে লইয়া বসিয়া, “রাণীজিকি জয়’ বলিয়া বাহিতে আরম্ভ করিল—সেই জাহাজের মত বজরা তখন তাঁরবেগে ছুটিল। এ দিকে দেখা গেল, বহুসংখ্যক পথিক বা হাটুরিয়া লোকের মত লোক নদীতীরে জঙ্গলের ভিতর দিয়া বজরায় সঙ্গে দৌড়াইয়া যাইতেছে। তাহাদের হাতে কেবল এক এক লাঠিমাত্ৰ—কিন্তু বজরার ভিতর বিস্তর ঢাল, সড়কী, বন্দুক আছে। ইহার দেবীর “বরকন্দাজ” সৈন্ত । সব ঠিক দেখিয়া, দেবী স্বহস্তে আপনার শাকান্নপাকের জন্য হাড়িশালে গেল। হায় ! দেবি !— তোমার এ কিরূপ সন্ন্যাস ! একাদশ পরিচ্ছেদ সোমবারে প্রাতঃস্থৰ্য্য-প্রভাসিত, নিবিড় কাননভ্যস্তরে দেবী রাণীর “দরবার” বা “এজলাস।" সে. এজলাসে কোন মোকৰ্দমা-মামলা হইত না । রাজকাৰ্য্যের মধ্যে কেবল একটা কাজ হইত— অকাতরে দান । নিবিড় জঙ্গল ; কিন্তু তাহার ভিতর প্রায় তিন শত বিঘা জমি সাফ হইয়াছে। সাফ হইয়াছে—কিন্তু বড় বড় গাছ কাটা হয় নাই—তাহার ছায়ায় লোক দাড়াইবে । সেই পরিষ্কার ভূমিখণ্ডে প্রায় দশ হাজার লোক জমিয়াছে । তাঁহারই মাঝখানে দেবী রাণীর এজলাস। একটা বড় সামিয়ান গাছের ডালে ডালে বাধিয়া টাঙ্গীন হইয়াছে। তার নীচে বড় বড় মোটা মোট রূপার দাণ্ডার উপর একখানা কিংখাপের চাদওয়া টাঙ্গান—ভাতে মতির ঝালর । তাহার ভিতর চন্দনকাষ্ঠের বেদী । বেদীর উপর বড় পুরু গালিচা পাতা । গালিচার উপর একখানা ছোট রকম রূপার সিংহাসন । সিংহাসনের উপর মসনদ পাতা, তাহাতেও মুক্তার ঝালর । দেবীর বেশভূষায় আজ বিশেষ জাক । সাড়ী পরা ! সাড়ীখানার ফুলের মাঝে মাঝে এক একখানা হীরা। অঙ্গ রত্নে খচিত—কদাচিৎ মধ্যে মধ্যে অঙ্গের উজ্জ্বল গৌরবর্ণ দেখা যাইতেছে। গলায় এত মতির হার ষে, বুকের আয় বস্ত্র পর্য্যস্ত দেখা যায় না । মাথায় রত্নময় মুকুট । দেবী তাজ শরৎকালের প্রকৃত দেবীপ্রতিমামত সাজিয়াছে । এ সব দেবীর রাণীগিরি, দুই পাশে চারি জন সুসজ্জিতা যুৱতী স্বর্ণ-দণ্ড চামর লইয়া বাতাস দিতেছে । পাশে ও সম্মুখে বহুসংখ্যক চোপদার ও আশাবরদার বড় জাকের পোষাক করিয়া বড় বড় রূপার আশা ঘাড়ে করিয়া খাড়া হইয়াছে সকলের উপর জাক বরকন্দাজের সারি । প্রায় পাঁচ শত বরকন্দাজ দেবীর সিংহাসনের দুই পাশে সায় দিয়া দাড়াইল । সকলের স্বসজ্জিত লাল পাগড়ি, লাল আঙ্গরাখা, লাল ধুতি মালকোচা মারা, পায়ে লাল নাগর, হাতে ঢালসড়কী । চারিদিকে লাল নিশান পোত । দেবী সিংহাসনে আসীন হইল। সেই দশ হাজার লোকে একেবারে “দেবী রাণীকি জয়” বলিয়া জয়ধ্বনি করিল । তার পর দশ জন সুসজ্জিত যুবা অগ্রসর হইয়া মধুরকণ্ঠে দেবীর স্তুতি গান করিল। তার পর সেই দশ সহস্র দরিদ্রের মধ্য হইতে এক এক জন করিয়া ভিক্ষার্থাদিগকে দেবীর সিংহাসন সমীপেরঙ্গরাজ