পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (দ্বিতীয় ভাগ).djvu/১১৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কৃষ্ণকাস্তের উইল জিজ্ঞাসা করিয়া আমাকে ত্যাগ করিয়া গেল? আমি আর সে ভ্রমরের মুখ দেখিব না। যাহার ভ্রমর নাই, সে কি প্রাণধারণ করিতে পারে ন! ?” এই ভাবিয়া গোবিন্দলাল ভ্রমরকে আনিবার জন্য লোক পাঠাইতে মাতাকে নিষেধ করিলেন । কেন নিষেধ করিলেন, তাহ কিছুই প্রকাশ করিলেন না । তাহার সন্মতি পাইয়। কৃষ্ণকান্ত বধু আনিবার জন্য আর কোন উদ্যোগ করিলেন না । পঞ্চবিংশতিতম পরিচ্ছেদ এইরূপে দুই চারি দিন গেল। ভ্রমরকে কেহ আমিল না । ভ্রমর ও আসিল না । গোবিন্দলাল মনে করিলেন, ভ্রমরের বড় স্পৰ্দ্ধ হইয়াছে, তাহাকে একটু কাদাইব । মনে করিলেন, ভ্রমর বড় অবিচার করিয়ছে, একটু কাদাইব । এক একবার শূন্ত গৃহ দেখিয়া আপনি একটু কাদিলেন। ভ্রমরের অবিশ্বাস মনে করিয়া এক একবার একটু কঁদিলেন। ভ্রমরের সঙ্গে কলহ, এ কথা ভাবিয়া কান্না আসিল । আবার চোখের জল মুছিয়া রাগ করিলেন । রাগ করিয়া ভ্রমরকে ভুলিবার চেষ্টা করিলেন । ভুলিবার সাধা কি ? মুখ যায়, স্মৃতি যায় না ; ক্ষত ভাল হয়, দাগ ভাল হয় না ; মানুষ সায়, নাম থাকে । শেষ দুৰ্ব্বদ্ধি গোবিন্দলাল মনে করিলেন ভ্রমরকে ভুলিলার উৎকৃষ্ট উপায় রোহিণীর চিন্ত । রোহিণীর অলৌকিক রূপপ্রভ একদিন ও গোবিন্দলালের হৃদয় পরিত্যাগ করে নাই ; গোবিন্দলাল জোর করিয়৷ তাহাকে স্থান দিতেন না, কিন্তু সে ছাড়িত না । উপন্যাসে শুনা যায়, কোন গৃহে ভূতের দৌরাত্ম্য হুইয়াছে, ভূত দিবারাত্র উকিঝুকি মারে কিন্তু ওঝা তাহাকে তাড়াইয়া দেয়। রোহিণী প্রেতিনী তেমনি দিবারাত্র গোবিন্দলালের হৃদয়-মন্দিরে উকিঝুকি মারে, গোবিন্দলাল তাহাকে তাড়াইয় দেন । যেমন জলতলে চন্দ্রস্থৰ্য্যের ছায়া আছে, চন্দ্রস্থৰ্য্য নাই, তেমনি গোবিন্দলালের হৃদয়ে অহরহঃ রোহিণীর ছায়া আছে, রোহিণী নাই । গোবিন্দলাল ভাবিলেন, যদি ভ্রমরকে আপাততঃ ভুলিতে হইবে, তবে রোহিণীর কথাই ভাবি —নছিলে এ দুঃখ ভুল যায় না। অনেক কুচিকিৎসক ক্ষুদ্র রোগের উপশমজন্য উৎকট বিষের প্রয়োগ করেন, গোবিন্দলালও ক্ষুদ্র রোগের উপশমজন্য উৎকট বিষের প্রয়োগে প্রবৃত্ত হইলেন। গোবিন্দলাল আপন ইচ্ছায় আপনি আপন অনিষ্টসাধনে প্রবৃত্ত হইলেন । রোহিণীর কথা প্রথমে স্মৃতিমাত্র ছিল, পরে দুঃঙ্গে পরিণত হইল। দুঃখ হইতে বাসনায় পরিণত হইল । গোবিন্দলাল বারুণীতটে পুষ্পবৃক্ষ পরিবেষ্টিত মগুপমধ্যে উপবেশন করিয়া সেই বাসনার জন্য অনুতাপ করিতেছিলেন । বর্ষাকাল । আকাশ মেঘাচ্ছন্ন ; বাদল হইয়াছে—বৃষ্টি কখনও কখনও জোরে আসিতেছে-কখনও মৃদ্ধ হইতেছে । কিন্তু বৃষ্টি ছাড়া . নাই । সন্ধ্য উৰ্ত্তীর্ণ হয়। প্রায়াগত যামিনীর অন্ধকার, তাহার উপর বাদলের অন্ধকার, বারণীর ঘাট স্পষ্ট দেখা যায় না। গোবিন্দলাল অস্পষ্টরূপে দেখিলেন যে, এক জন স্ত্রীলোক নামিতেছে। রোহিশীর সেই সোপানাবতরণ গোবিন্দলালের মনে হইল। বাদলে ঘাট বড় পিছল হইয়াছে—পাছে পিছলে প৷ পিছলাইয়। স্ত্রীলোকটি জলে পড়িয়। গিয়া বিপদগ্ৰস্ত হয়, ভাবিয়া গোলিন্দলাল কিছু ব্যস্ত হইলেন । পুষ্পমণ্ডপ হইতে ডাকিয়া বলিলেন, “কে গ৷ তুমি ? অাজ ঘাটে নামিও ন—বড় পিছল, পড়িয়। যাইবে।” স্ত্রীলোকটি র্তাহার কথা স্পষ্ট বুঝিতে পারিয়াছিল কি না, বলিতে পারি না । বৃষ্টি পড়িতেছিল—বোধ হয়, বৃষ্টির শব্দে সে ভাল করিয়া শুনিতে পায় নাই । সে কুক্ষিস্থ কলসী ঘাটে নামাইল। সোপান পুনরারোহণ করিল। ধীরে ধীরে গোবিন্দলালের পুষ্পোপ্তানঅভিমুখে চলিল । উদ্যান দ্বার উদঘাটিত করিয়া উদ্যানমধ্যে প্রবেশ করিল। গোলিন্দলালের কাছে মণ্ডপতলে গিয়া দাড়াইল । গেবিন্দলাল দেখিলেন, সম্মুখে রোহিণী । গোবিন্দলাল বলিলেন, "ভিজিতে ভিজিতে এখানে কেন রোহিণি ?" রে। আপনি কি আমাকে ডাকিলেন ? গো । ডাকি নাই । ঘাটে বড় পিছল, নামিতে বারণ করিতেছিলাম । দাড়াইয়া ভিজিতেছ কেন ? রোহিণী সাহস পাইয়। মণ্ডপমধ্যে উঠিল। গোবিনলাল বলিলেন “লোকে দেখিলে কি বলিবে ?” রে । যা বলিবার, তা বলিতেছে । সে কথা আপনার কাছে একদিন বলিব বলিয়া অনেক যত্ন করিতেছি । গো । আমারও সে সম্বন্ধে কতকগুলি কথা জিজ্ঞাসা করিবার আছে। কে এ কথা রটাইল ? তোমরা ভ্রমরের দোষ দাও কেন ? রো। সকল বলিতেছি । কিন্তু এখানে দাড়াইয়া বলিব কি ? গো । না, আমার সঙ্গে আইস ।