পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (দ্বিতীয় ভাগ).djvu/২২৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সীতারাম কাটিতে পারিত না, কিন্তু নগরপ্রান্তে বক্রি, মেড়া কাটিয়া বেচিত । সে ব্যক্তি অতিশয় বলবান ও কদাকার । সে রাজাজ্ঞা পাইয়া, মঞ্চের উপর উঠিয়া, বেত হাতে করিয়া জয়ন্তীর সম্মুখে দাড়াইল । বেত উচু করিয়া কসাই জয়ন্তীকে বলিল, “কাপড়া উতাবৃ— তেরি গোশত টুকর টুকরা করকে হাম দোকানমে বেচেঙ্গে " জয়ন্তী তখন অপরিস্নানমুখে, জনসমারোহকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “রাজাজ্ঞায় এই মঞ্চের উপর বিবস্ত্র হইব । তোমাদের মধ্যে যে সতীপুত্র হইবে, সেই আপনার মাতাকে স্মরণ করিয়া ক্ষণকালের জন্য এখন চক্ষু আবৃত করুক। যাহার কন্যা আছে, সেই আপনার কন্যাকে মনে করিয়া আমাকে সেই কন্যা ভাবিয়া চক্ষু আবৃত করুক। যে হিন্দু—যাহার দেবতা-ব্রাহ্মণে ভক্তি আছে, সেই চক্ষু আবৃত করুক । যাহার মাতা অসতী, যে বেষ্ঠার গর্ভে জন্মিয়াছে, সে যাহা ইচ্ছা করুক, তাহার কাছে আমার লজ্জা নাই, আমি তাহাদের মনুষ্যমধ্যে গণ করি না । লোকে এই কথা শুনিয়া চক্ষু বুজিল কি না বুজিল, জয়ন্তী তাহা আর চাহিয়া দেখিল ন! ! মন তখন খুব উচু স্বরে বাধা আছে-জয়ন্তী তখন জগদীশ্বর ভিন্ন আর কাহাকেও দেখিতে পাইতেছে ন! ! জয়ন্তী কেবল রাজার দিকে ফিরিয়। বলিল, “তোমার আজ্ঞায় আমি বিবস্ত্র হইব । কিন্তু তুমি চাহিয়া দেখিও ন । তুমি রাজ্যেশ্বর, তোমার পশুবৃত্তি দেখিলে প্রজার কি না করিবে ? মহারাজ ! আমি বনবাসিনী, বনে থাকিতে গেলে অনেক সময় বিবস্ত্র হইতে হয় । একদ। আমি বাঘের মুখে পড়িয়াছিলাম,—বাঘের মুখ হইতে আপনার শরীর রক্ষা করিতে পারিয়াছিলাম কিন্তু বস্ত্র রক্ষা করিতে পারি নাই । তোমাকেও আমি তোমার আচরণ দেখিয় সেইরূপ বন্যপশু মনে করিতেছি ; অতএব তোমার কাছে আমার লজ্জা হইতেছে না । কিন্তু তোমার লজ্জ হওয়া উচিত— কেন না, তুমি রাজা এবং গৃহী ; তোমার মহিষী আছেন । চক্ষু বুজ ।” বৃথা বলা ! তখন মহাক্রোধান্ধকারে রাজ একে বারে অন্ধ হইয়াছিলেন । জয়ন্তীর কথার কোন উত্তর না দিয়া কসাইকে ‘বলিলেন, “জবরদস্তী কাপড় উতার লেও।” তখন জয়ন্ত্রী আর বৃথা কথা না কহিয়া, জামু পাতিয়া মঞ্চের উপর বসিল । জয়ন্তী আপনার কাছে আপনি ঠকিয়াছে—এখন বুঝি জয়ন্তীর চোখে জল আসে । জয়ন্তী মনে করিয়াছিল, “যখন পৃথিবীর ৬৯ সকল সুখদুঃখে জলাঞ্জলি দিয়াছি, যখন আর আমার মুখও নাই দুঃখও নাই, তখন আমার আবার লজ্জা । কি ? ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে আমার মনের যখন কোন সম্বন্ধ নাই, তখন আমার আর বিবস্ত্র আর সবস্ত্র কি ? পাপই লজ্জা, আবার কিসে লজ্জা করিব ? জগদীশ্বরের নিকট ভিন্ন সুখদুঃখের অধীন মনুষ্যের কাছে লজ্জা কি ? আমি এই সভামধ্যে বিবস্ত্র হইতে, পারিব না ?” তাই, জয়ন্তী এতক্ষণ আপনাকে বিপন্ন মনে করে নাই—বেত্ৰাঘাতটা ত গণ্যের মধ্যে নহে। কিন্তু এখন যখন বিবস্ত্র হইবার সময় উপস্থিত হইল —তখন কোথা হইতে পাপ লজ্জা আসিয়া সেই ইন্দ্রিয়ুবিজয়িনী সুখদুঃখবিবর্জিত জয়ন্তীকে অভিভূত করিল । তাই নারীজন্মকে ধিক্কার দিয়া জয়ন্তী মঞ্চতলে জ’ন্ত পাতিয়া বসিল ; তখন যুক্তকরে পবিত্রচিত্তে জয়ন্তী আত্মাকে সমাহিত করিয়া মনে মনে ডাকিতে লাগিল, “দীনবন্ধু । আজ রক্ষ কর । মনে করিয়াছিলাম, বুঝি এ পুথিবীর সকল সুখদুঃখে জলাগুলি দিয়াছি, কিন্তু দর্পহারী ; আমার দর্প চূর্ণ হইয়াছে, আমায় আজ রক্ষা কর । নারীদেহ কেন দিয়াছিলে, প্ৰভু ! সব সুখদুঃখ বিসর্জন করা যায়, কিন্তু নারীদেহ থাকিতে লজ্জা বিসর্জন করা যায় না । তাই আজি কাতরে ডাকিতেছি, জগন্নাথ ; আজ রক্ষা কর ।” যতক্ষণ জয়ন্তী জগদীশ্বরকে ডাকিতেছিল, ততক্ষণ কসাই তাহার অঞ্চল ধরিয়৷ আকর্ষণ করিতেছিল । দেখিয়া সমস্ত জনমণ্ডলী এককণ্ঠে হাহাকার করিতে লাগিল—বলিতে লাগিল, “মহারাজ ! এই পাপে তোমার সৰ্ব্বনাশ হইবে—তোমার রাজ্য গেল !" রাজ। কর্ণপাত করিলেন না ; নিরুপায় জয়ন্ত্ৰী আপনার অঞ্চল ধরিয়া টানাটানি করিতেছিল, ছাড়িতেছিল না । তাহার চক্ষু দিয়া জল পড়িতে ছিল । ঐ থাকিলে বড় বিস্মিত হইত। জয়ন্তীর চক্ষুতে আর কখনও কেহ জল দেখে নাই। জয়ন্ত্ৰী রুধিরাক্তক্ষত হস্তে আপনার অঞ্চল ধরিয়া ডাকিতেছিল, “জগন্নাথ । রক্ষা কর ” - বুঝি জগন্নাথ সে কথা শুনিলেন, সেই অসংখ্য জনসমূহ হাহাকার করিতে করিতে সহসা আবার জয়ধ্বনি করিয়া উঠিল । “রাণীজীকি জয় ! মহা । রাণীজিকি জয় ! দেবীকি জয় !" এই সময়ে অধোমুখী জয়ন্তীর কর্ণে অলঙ্কারশিঞ্জিত প্রবেশ করিল। তখন জয়ন্তী মুখ তুলিয়া চাহিয়া দেখিল, সমস্ত পৌরস্ত্রী সঙ্গে করিয়া মহারাণী নন্দা মঞ্চোপরি আরোহণ করিতেছেন। জয়ন্তী উঠিয়া দাড়াইল ।