পাতা:বাংলায় ভ্রমণ -দ্বিতীয় খণ্ড.pdf/৩৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পূবর্ববঙ্গ রেলপথে বাংলাদেশ ー&) তিস্তার সংস্কৃত নাম ত্রিস্রোতা। কালিকা পুরাণে লিখিত আছে যে একবার পাবর্বতী এক দানবের সহিত ভীষণ যুদ্ধ করিবার সময়ে শিবভক্ত এই দানৰ শিবের নিকট তৃষ্ণ নিবারণের জন্য জল প্রার্থনা করেন। শিবের বরে পাবর্বতীর বক্ষ হইতে তিনটি ধারায় এই নদী বাহির হইয়া আসে। বেশী দিনের কথা নয় তিস্ত দক্ষিণে বহিয়া আত্রাই ও করতোয়ার খাতে পদ্মায় গিয়া পড়িত। ১৭৮৭ খৃষ্টাব্দের ভীষণ বন্যার সময়ে তিস্ত পুরাতন খাত ছাড়িয়া দক্ষিণ-পূৰেৰ বত্তমান খাত কাটিয়৷ ব্ৰহ্মপুত্রে যাইয়া মিলিত হয়। তিস্ত জংশন হইতে একটি শাখা লাইন ১৫ মাইল দূরবর্তী কুড়িগ্রাম পৰ্য্যস্ত গিয়াছে। এই শাখাপথে তিস্তা জংশন হইতে ৪ মাইল দূরে সিংহেরদাবড়ি-হাট স্টেশনের নিকটে বহুকাল হইতে প্রতি বৎসর মাঘ ফাত্তন মাসে "সিন্দূরমতীর মেলা ” নামে প্রায় এক সপ্তাহব্যাপী একটি মেলা হইয়া থাকে। রংপুর জেলার সুপ্রসিদ্ধ মাণিক চত্র ও গোপীচন্দ্রের গানের ময়নামতী ও সিঙ্গুরমতীর কথা ইহা সমরণ করাইয়া দেয় ; সম্ভবতঃ এই সিন্দরমতী গ্রাম্য গীতিতে স্থান পাইয়াছেন এবং তাঁহার নামেই মেলাটি চলিয়া আসিতেছে । ’ কুঁড়িগ্রাম—পার্বতীপুর জংশন হইতে ৫৩ মাইল। ইহা রংপুর জেলার একটি মহকুমা । শহরটি ধরলা নদীর তীরে অবস্থিত ও পাটের কারবারের জন্য বিখ্যাত। এই স্থান হইতে ১০ মাইল দক্ষিণ-পূবেৰ্ব গিয়া ধরলা ব্ৰহ্মপুত্রে পড়িয়াছে। কথিত আছে, প্রাচীন কোচরাজ্য মুসলমানগণ কত্ত্বক বিজিত হইলে উক্ত রাজ্যের কুচওয়ারা অঞ্চলের কুড়িটি মেচ পরিবার এই স্থানে আসিয়া বসবাস করেন বলিয়া ইহার নাম হয় কুড়িগ্রাম। এই মেচগণ এখন সম্পূর্ণরূপে বাংলার হিন্দু সমাজের কুরী নামক জাতির সহিত মিশিয়া গিয়াছেন। কুড়িগ্রাম একটি স্বাস্থ্যকর স্থান। ধরলা নদীর ভাঙনের জন্য শহরটির মধ্যে মধ্যে বিশেষ ক্ষতি হয় । কুড়িগ্রাম হইতে ১১ মাইল দক্ষিণে উত্তর-বঙ্গের সুবিখ্যাত বাহিরবন্দ পরগণার প্রধান স্থান উলিপুর যাইতে হয়। বাহিরবন্দ পরগণার জমিদারী পূর্বে কোচরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৬০৩ খৃষ্টাব্দে রাজা পরীক্ষিতের সময়ে ইহা মুঘলগণ কত্ত্বক বিজিত হয়। এখন ইহা কাশীমবাজারের মহারাজার সম্পত্তি হইয়াছে। . উলিপুরের ৫ মাইল পশ্চিমে ওয়াড়ি নামক স্থানে কতকগুলি ধংসাবশেষ দৃষ্ট হয়। ইহা গোপীচন্দ্র রাজার একটি বাটির ধ্বংসাবশেষ বলিয়া কথিত। প্রধান লাইনের ডোমার স্টেশন দ্রষ্টব্য। রংপুর জেলার “গোপীচন্দ্রের গান” নামক লৌকিক গাথা-সাহিত্যের নায়ক রাজা গোপী চন্দ্র বা গোপীচাঁদ কাহারও কাহারও মতে ১০০৫ খৃষ্টাব্দ হইতে ১০৩০ খৃষ্টাব্দ পর্য্যস্ত রাজত্ব করেন ; আবার কেহ কেহ তাঁহাকে চতুর্দশ শতাব্দীর লোক বলিয়া অনুমান করিয়াছেন। গোপীচাঁদ ঢাকা জেলার অন্তর্গত সাভারের রাজা হরিশ্চন্দ্রের অদুনা ও পদুনা নামক দুই কন্যাকে বিবাহ করেন। তাহার জননী রাণী ময়নামতী হাড়িসিদ্ধা নামক এক সিদ্ধপুরুষের শিষ্য ও যাদুবিদ্যায় পারদশিনী ছিলেন বলিয়া তাহার চরিত্র সম্বন্ধে নানারূপ দুর্নাম রটে। পত্নীদ্বয়ের পরামর্শে গোপীচাঁদ স্বীয় জননীকে উত্তপ্ত তৈলকটাহে নিক্ষেপ করিয়া হত্যা করেন। পরে নিজের ভুল বুঝিতে পারিয়া তিনি বিশেষ অনুতপ্ত হন ও স্বয়ং হাড়িসিদ্ধার শিষ্যত্ব গ্রহণ করিয়া বৈরাগ্য অবলম্বন করেন। বাংলার বাউলগণ গোপীযন্ত্র নামক যে বাদ্য যন্ত্রের সহিত গান করেন, উহা রাজা গোপীচাঁদের সময়ে প্রথম প্রবত্তিত হয় বলিয়া প্রসিদ্ধ আছে। গোপীচক্রের গান রংপুর জেলার সবর্বত্র গীত হয় এবং ভারতবর্ষের নানাস্থানে ইহা অল্পবিস্তর পরিবত্তিত হইয়া বিস্তৃতি লাভ করিয়াছে।