বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:বাখতিন - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১০৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

সংগ্রামের অপরিহার্যতাকে কীভাবে গ্রহণ করতে পারে একবাচনিক আভিজাত্যে অভ্যস্ত জনেরা?

 কোনো তত্ত্বপ্রস্থান বা সেই তত্ত্বপ্রস্থানের পাঠ ও বিশ্লেষণ ইতিহাসের বাইরে যেতে পারে না। ইতিহাসকে অস্বীকার করলে গোলকধাঁধা তৈরি হয়ে মাত্র। অন্যত্র লিখেছি, দ্বিবাচনিকতা নিছক নান্দনিক কৃৎকৌশল নয়; তা জীবনদর্শনের সারাৎসার। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক স্তরে তাকে উপেক্ষা কিংবা কুঠারাঘাত করলে নিছক বৌদ্ধিক চর্চায় তা আলোচনার অধিকার থাকে না। এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার পর্যায়ে যাবতীয় অপর পরিসরের স্বাতন্ত্র্য, সার্বভৌমত্ব ও সমান্তরাল অবস্থানের অধিকার যারা ক্রমাগত কেড়ে নিচ্ছে এবং নিজেদের প্রয়োজন-মাফিক সত্য উৎপাদন করছে—তাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় পুষ্ট বুদ্ধিজীবীরা দ্বিবাচনিক বিশ্ববীক্ষাকে কেনই বা সমর্থন করবেন? তাদের ‘নিরপেক্ষ’ সত্য সন্ধান আমাদের কোথায় নিয়ে যেতে পারে—তা সহজেই অনুমেয়। অন্তত যে-পৃথিবীতে ইরাক-বসনিয়া-কসভো-সোমালিয়া-আফগানিস্থানের ঘটনাবলি সম্ভব, সেই পৃথিবীর উন্নততম তথ্য-প্রযুক্তির সমর্থনধন্য বৌদ্ধিকবর্গ বাখতিনের ভ্রান্ত পাঠই করতে পারেন শুধু।

 বিখ্যাত বাখতিন-আলোচক ক্যারিল এমার্সন The first hundred years of Mikhail Bakhtin বইয়ের প্রাক্‌কথনে লিখেছেন: ‘The Bakhtin industry has known its share of gossip, turfwars, unsubstantiated rumour, dialogue in bad faith, nostalgic fantasy and willful misreadings.’ (১৯৯৭: দশ)। এই যে ইচ্ছাকৃত ভ্রান্ত পাঠের কথা বলা হলো, তাতে তৃতীয় বিশ্বের যেসব ভাষ্যকারেরা জড়িয়ে পড়েন, এর মূলে রয়েছে প্রথম বিশ্বের বৌদ্ধিক বর্গের প্রতি নির্বিচার আনুগত্য ও অবিশ্লেষণাত্মক পাঠের আভাস। স্বয়ং এমার্সনের বক্তব্য সম্পর্কে একই কথা প্রযোজ্য। আমরা যারা তুলনামূলক ভাবে ছোট সময়ের অধিবাসী, জীবনবৃত্তের সীমাবদ্ধতা বা অভিজ্ঞতার অতিসংলগ্নতা সত্ত্বেও খোলা মনে চিন্তাবিশ্বের মুখোমুখি হতে আমাদের কোনো বাধা হওয়ার কথা নয়। এমার্সন-কথিত মিথ্যা বিশ্বাসের চাপ অবশ্যই অনস্বীকার্য বাস্তব। তবু তাৎপর্য অর্জনের সংগ্রামী প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতেই হয়। নব্বই-এর দশকে প্রতিবিপ্লব-পরবর্তী খণ্ডীকৃত রাশিয়ার তথাকথিত উত্তর-সমাজতন্ত্রী পর্যায়ে বাখতিন কীভাবে পুনঃপঠিত হচ্ছেন, এ সম্পর্কে এমার্সন তথ্য-সমৃদ্ধ মনোজ্ঞ আলোচনা করেছেন। প্রমাণ করার চেষ্টা চলেছে যে সমাজতান্ত্রিক ভাবাদর্শ তো নয়ই, কোনো রাজনীতিও তাঁর চিন্তাজীবনকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করতে পারেনি। নিষ্ঠুর অত্যাচারী শাসকের পীড়ন সত্ত্বেও তিনি কীভাবে রয়ে গেলেন চিরমুক্ত, গৃহহীন ও অসম্পৃক্ত—তা অনুসন্ধান করে আলোচকেরা বাখতিন সম্পর্কে কার্যত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। অথচ তাঁরই বিখ্যাত তত্ত্ববীজ অনুযায়ী (‘জীবন ও সাহিত্যের প্রতিবেদন কখনও চূড়ান্ত করা যায় না’) আলোচকদের ঐ প্রবণতা সমর্থন করা যায় না।

 তাঁর মধ্যে কেউ কেউ দেখতে পেয়েছেন সাম্যবাদ-উত্তর আধুনিকোত্তর চিন্তাধারার পূর্বাভাস। প্রকৃতপক্ষে তাঁর অবস্থান খোঁজা হচ্ছে ‘Somewhere between a classic and cliche’ (তদেব: ৩)। বিশেষত আধুনিকোত্তর ভাবনার প্রেক্ষিতে বাখতিনের চিন্তাবিশ্বের বিবর্তন ব্যাখ্যা করার চেষ্টাও লক্ষ করা যায়। তবু রুশ ভাষ্যকার ভি. এল. মাখলিন-এর মতে বাখতিনকে বুঝতে হবে নেতি নেতি করে। তাঁকে বলা যায় ‘non-Marxist, nonformalist, Non Freudian, non-structuralist, nonexistentialist, noncollectivist,

১০২