বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:বাখতিন - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৪৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

উৎস। সাহিত্যে যে-সমস্ত ধূর্ত, বিদূষক, শঠ চরিত্রদের দেখা যায়-তাদের প্রেরণা কার্নিভাল চেতনা। বাখতিনের মতে এই ঐতিহ্যই ঔপন্যাসিক প্রতিবেদনের পূর্বসূরি। লোকায়ত আঙ্গিকের মধ্যে হাস্যরস সক্রিয় ছিল মুক্তিদাতা শক্তি হিসেবে: ‘they feed con sciousness from the power of the direct word, destroyed the thick walls that had imprisoned consciousness within its own discourse.’ (১৯৮১: ৬০)। উপন্যাসে যখন অন্তর্বয়ন হিসেবে সক্রিয় হয়ে ওঠে কার্নিভাল, প্রশস্ততর হয়। দ্বিবাচনিকতার ক্ষেত্র।

 এই পর্যায়ে ‘ক্রনোটোপ’ নামে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ববীজের অবতারণা করেছেন বাখতিন। এই পারিভাষিক শব্দটির মানে হলো সময় ও পরিসরের পর্যায়ক্রম। শিল্পী মানুষের জীবনকে সর্বদা জগতের নির্দিষ্ট পরিসরে ও সময়ে যথাপ্রাপ্ত অবস্থানে পর্যবেক্ষণ করেন। উপন্যাসের প্রতিবেদনে নায়ক নায়িকা অনৈতিহাসিক নয় কখনো, তেমনি নয় অসামাজিক বা সময়নিরপেক্ষ। মানবিক অস্তিত্বকে ইতিহাসের পরিসরে ও কালের মাত্রায় দেখানোর দায়িত্ব নেয় উপন্যাস। বাখতিন মনে করেন, উপন্যাস প্রকরণের ক্রমবিকাশ প্রধানত হচ্ছে ‘a chronotopic understanding of the human being as satu rated in historical existence.’ (মোরিস: ১৯৯৪: ১৯)। ‘Epic and Novel’ নামক নিবন্ধে বাখতিন কার্নিভাল-চেতনা ও ক্রনোটোপের মধ্যে সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছেন। মহাকাব্যের দুর্ভেদ্য জগৎ বদ্ধ উপসংহারে বিন্যস্ত কেননা তা সমসাময়িক বাস্তব থেকে বিচ্ছিন্ন চূড়ান্ত অতীতে গ্রথিত; অন্যদিকে উপন্যাসের জগৎ বিকাশমান আর অসমাপ্ত। যেন উতরোল পরিহাসের মধ্য দিয়ে তা বর্তমানকে কেবলই পুনর্মূল্যায়ন ও পুনর্বিশ্লেষণ করে চলেছে (১৯৮১: ১৭)। ইতিহাসের সন্দর্ভে প্রধান উচ্চারণ হিসেবে যা কিছু একান্তিকভাবে মান্য ছিল বহুদিন, তাকেই দূরীকৃত অপর হিসেবে পরিচিত কার্নিভাল বদলে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছে। দ্বিবাচনিক প্রক্রিয়া তাই সাহিত্যের দিগন্ত বিস্তার কিংবা গভীরতার অভিযাত্রায় অনস্বীকার্য।

 আশ্চর্য এক জীবন পেয়েছিলেন বাখতিন। ইতিহাসের এত বাঁক-ফেরা একই জীবনে দেখা ও বোঝার সুযোগ বড়ো একটা পাওয়া যায় না। তত্ত্ব ও জীবন তাঁর কাছে তাই হয়ে উঠেছিল অনেকার্থদ্যোতনার দুটি ভিন্ন ধরনের অভিব্যক্তি। জীবনানন্দের ভাষা অনুসরণ করে বলা যায়, একই জিনিসের দু’রকম উৎসারণ। তাঁর জীবনব্যাপী অর্জিত উচ্চারণ-সমবায় থেকে কোনো-একটি বিশেষ বিন্দুকে বেশি গ্রাহ্য বা বেশি উজ্জ্বল বলে গুরুত্ব দেওয়াটা সমীচীন নয়। তাঁর মৃত্যুতেও চূড়ান্ত মীমাংসা হলো না কেননা সমাপ্তি বলে তো কিছু নেই সত্যসন্ধানের ক্ষেত্রে। আমরা ইতিমধ্যে জেনেছি, সমস্ত সমাপ্তি আসলে আপাত-সমাপ্তি। দ্বিবাচনিকতার প্রেক্ষিতে সীমা নেই কোনো। এই মুহূর্তে যদি কিছু বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যায়ও কোনো-এক উদ্ভাসিত ভবিষ্যতে স্মৃতিগ্রথিত হয়ে ফিরে আসবে তাও। পুনর্মূল্যায়ন অব্যাহত থাকবে মুহূর্ত-পরম্পরার জীবনে। অনিশ্চিত এই আধুনিকোত্তর সময়পর্বে এখানেই বাখতিনের চিন্তাবৃত্তের প্রাসঙ্গিকতা।

৪২