পাতা:বাখতিন - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৫৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

সামূহিক বাচনের সঞ্চরমান পরিসর থেকেই জেগে ওঠে উচ্চারণের নিজস্ব নন্দন—তার সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক তাৎপর্য। বাখতিন তাই লিখেছেন: ‘Every utterance in the business of life is akin to a password.’ (১৯৭৬: ১০৬)।

 এই অনন্যতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। জীবন বাইরে থেকে উচ্চারণের উদ্ভব ও বিকাশকে প্রভাবিত করে না, অস্তিত্বের গহনে অন্তর্ভেদী আলো নিক্ষেপ করে সেখানেই সন্ধান করে চিহ্নায়নের উৎস। সত্তা ও অপরতা সম্পর্কে সামাজিক মূল্যায়নের প্রেরণাও তাতে সূক্ষ্মভাবে সম্পৃক্ত থাকে। উচ্চারণের নান্দনিক ও সামাজিক স্বভাবকে আলাদাভাবে দেখাতে ও দেখতে আমরা অভ্যস্ত। কিন্তু বাখতিনের ভাবনা-প্রস্থান যদি অনুসরণ করি, তাহলে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হয় যে, নন্দন মূলত সামাজিক সংবেদনারই বিশিষ্ট অভিব্যক্তি। তাই শিল্প-সাহিত্য-উচ্চারণের তত্ত্ব মূলত সৃষ্টির সমাজতত্ত্ব। সংযোগের মধ্যেই সৃষ্টির সার্থকতা; আর, উচ্চারণ অনবরত রূপান্তরিত হয় সংযোগের সামাজিক প্রেক্ষিত অনুযায়ী। ঠিক এখানেই ভাবাদর্শের প্রসঙ্গটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বাচকের চেতনা ও অবচেতনা ভাবাদর্শে গ্রথিত বলেই তার নিজস্ব উচ্চারণশৈলী বা প্রকাশভঙ্গি সে কখনো বদলাতে পারে না। আবার প্রেক্ষিত ও পাঠকৃতির মধ্যে অচ্ছেদ্য সম্পর্ক যেহেতু উচ্চারণের সূত্রেই নির্ণীত হয়ে থাকে, সত্তা ও অপরতার আকরণ ও সংশ্লিষ্ট মূল্য-প্রকরণ আমাদের অভিনিবেশ দাবি করে। উচ্চারণের অনন্যতা সত্ত্বেও তাকে কখনো অনিকেত বা পৌর্বাপর্যহীন বলে ভাবা যায় না। বাখতিনের চিন্তাবিশ্বে জীবন ও তাৎপর্য একই সূত্রে গাঁথা বলে প্রেক্ষিতের রূপান্তরে জীবন ও তাৎপর্য রূপান্তরিত হয়ে যায়। অর্থাৎ জীবন ও তাৎপর্য রুদ্ধ নয়, তা মুক্ত ও স্বাধীন। কিন্তু এই মুক্তি বা স্বাধীনতার অর্থ স্বেচ্ছাচারিতা নয় কখনো। সত্তা বা পাঠকৃতির মৌল উপাদান হিসেবে উচ্চারণ কখনো সম্পূর্ণ সার্বভৌম হতে পারে না।

 এর অন্যতম বড়ো কারণ হলো সাংস্কৃতিক রাজনীতির অমোঘ প্রভাব। তার মানে, উচ্চারণেরও রয়েছে নিজস্ব রাজনীতি। সরকারি ও বেসরকারি কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক ভাবাদর্শের সংঘর্ষ থেকে বিচ্ছুরিত বহুবাচনিক আবহে উচ্চারণ জন্ম নেয়, পুষ্ট হয় ও রূপান্তরের পথে যাত্রা করে। এই প্রক্রিয়ায় সত্তা ও অপরতার বহুস্তর-বিন্যস্ত সম্পর্কের জটিলতাও ব্যক্ত হয় বলে উচ্চারণ-শৈলীকে কখনো একটি পূর্বনির্দিষ্ট আকরণে রুদ্ধ করতে পারি না। অজস্র পার্থক্য-প্রতীতির উপলব্ধিতে উচ্চারণ গড়ে ওঠে বলে ঐ প্রতীতির মধ্যেই সাংস্কৃতিক রাজনীতির নির্যাস প্রতিফলিত হয়। বাখতিন লিখেছেন: ‘The internal politics of a style is determined by its external politics’. (১৯৮১: ২০৪)। অর্থাৎ শৈলীরও রয়েছে নিজস্ব রাজনীতি, অন্তর্বৃত ও বহির্বৃত সংগ্রামের বাধ্যবাধকতা; বিবিধ বিকল্পের সম্ভাবনা থেকে অমোঘ অভিব্যক্তিতে পৌঁছানো। তার মানে, উচ্চারণের যেমন রাজনীতি আছে, তেমনি উচ্চারণ নিজেই হয়ে উঠেছে বিশিষ্ট রাজনীতি। আর, এই ভিত্তিতেই গড়ে উঠেছে তার নিজস্ব নন্দন, মুক্তির প্রতীতি। উচ্চারণে অন্তর্বৃত মুক্তি পাঠকৃতির নন্দনকে উত্তীর্ণ করছে মানব পরিসরে মুক্তির উৎসবে। ভাষার জন্ম ও বিকাশ সীমা নিরাকরণের মধ্য দিয়েই ঘটে। প্রসঙ্গের দ্বিবাচনিক ভূমিকা মেনে নিয়েও তা শেষ পর্যন্ত প্রসঙ্গাতীত হয়ে ওঠে। বলেই ভাষার দ্যোতনা রহস্যগর্ভ ও উৎক্রান্তিসূচক। ব্যবহার-বিধি অনস্বীকার্য; কিন্তু সেই বিধি-বিন্যাসকে যদি প্রতি মুহূর্তে প্রত্যাহ্বান না জানায়, তাহলে আকরণগত রুদ্ধতা শুধু শৃঙ্খলই তৈরি করবে।

বাখতিন - ৪
৪৯