পাতা:বাখতিন - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৫৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

শ্রোতা, সম্বোধক ও সম্বোধিত, বাচক ও গ্রহীতার পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্য দিয়েই উচ্চারণ গড়ে উঠতে পারে। ব্যক্তিসত্তা ও সামাজিক অপরের দৃশ্যমান ও অদৃশ্য সম্পর্কের অভিব্যক্তিই হলো উচ্চারণ। অপরের দৃষ্টিকোন থেকে আপন অস্তিত্বের বাচনিক অভিব্যক্তি যখন তৈরি করতে চাই, আমরা আসলে সময় ও পরিসরে বিধৃত সামাজিক বীক্ষাকেই প্রকাশ করি। তাই বাখতিন শব্দকে সত্তা ও অপরতার সেতু বলে মনে করেছেন।: ‘a world is a bridge thrown between myself and another...it is territory shared by both addresser and addressee.’ (তদেব)।

 এই বক্তব্যের সূত্রে কবিতা ও ছোটগল্পের সংযোগ প্রকরণ সম্পর্কে আমাদের ভাবনা পুরোপুরি নতুন খাতে বয়ে যেতে পারে। বহুস্বরিক উচ্চারণের মধ্য দিয়েই জীবনের কোষে সঞ্চারিত হতে পারে ভাষা। তা যুগপৎ মূর্ত ও বিমূর্ত, সহজ ও জটিল, বাস্তব.ও অধিবাস্তবকে ধারণ করতে পারে: এই বিস্ময়কর উপলব্ধি হয় আমাদের। কোনো কবি বা গল্পকার নিজস্ব ধরনে সম্বোধ্যমানতার নতুন প্রকরণ খুঁজে নিতে চান। ভাষার মধ্যে যা-কিছু যথাপ্রাপ্ত উপাদান সামূহিক বাচন হিসেবে সর্বদাই পূর্বনির্ধারিত ও পূর্বাগত, তাদের ব্যবহারবিধিকে মান্যতা দিয়েও একক বচনের উপস্থাপয়িতা হিসেবে সম্বোধক সর্বদাই নতুন সজীব ভাষার আয়তন নির্মাণ করেন। তা যদি না হত, কোনো নির্দিষ্ট কাব্যভাষা বা গল্পভাষাকে আমরা কখনও অনন্য ভাবতে পারতাম না। এই অনন্যতার মানেই হলো, এইমাত্র এমন একক বাচন সৃষ্টি হয়েছে, যা সৃষ্টি হওয়ার পূর্বমুহুর্তেও অজানা ছিল। বাচনের মতো তার প্রেক্ষিতও অনবদ্য। আমরা যখন চিহ্নায়ন প্রকরণে চিহ্নায়ক ও চিহ্নায়িতের দ্বিবাচনিকতা নিয়ে ভাবি, তাতেও একক ও সামূহিক বাচনের দ্বিরালাপ নানাভাবে সক্রিয় থাকে। কোনো কবি বা গল্পকার উচ্চারণের বিশিষ্টতায় বস্তুকে চিহ্নায়কে রূপান্তরিত করেন, সম্ভাব্য পাঠকের কাছে ন্যূনতম কিছু প্রত্যাশা তো থেকেই যায়। চিহ্নায়ন প্রকরণ সম্পূর্ণ ও সার্থক হতে পারে যদি সম্বোধিত জনেরা ঠিকমতো তাতে সাড়া দিতে পারেন—এ তো অনস্বীকার্য। বাচনের অর্থ এভাবে চূড়ান্ত হয়ে যাচ্ছে, তা কিন্তু নয়, কেননা তাৎপর্য-প্রতীতিতে আপাতসম্পূর্ণ মাত্র আভাসিত হতে পারে। চূড়ান্তকরণ প্রক্রিয়া বারবার পুনর্নবায়িত হয় নতুন গ্রাহকের চেষ্টায়, তার এই চেষ্টা আংশিক ও সাময়িক মাত্র। অতএব চূড়ান্ত মুহূর্ত কেবলই নাগাল এড়িয়ে যায়, আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে যায়। নিজেকে কর্ষণ করে ভাষা, নিজের প্রথা-নির্দেশিত সীমাকে নিজেই চূর্ণ করে যায়। এই সূত্রে স্পষ্ট হয়ে ওঠে নিবিড় দ্বিরালাপের আবহ, কেননা তাৎপর্য প্রেক্ষিতের সীমানাকে মান্যতা দিলেও প্রেক্ষিত নিজের সীমাকে অনবরত প্রসারিত করে যায়। এ তো অনিবার্য; কারণ, পরিবর্তমান সময়-স্বভাব অনুযায়ী প্রেক্ষিত বদলে যেতে বাধ্য। প্রেক্ষিতের এই সীমাহীনতাই অনেকার্থদ্যোতনার উৎস। বাচনের নন্দনে তাই অচল অনড় আকরণ নেই, জিজ্ঞাসারহিত ধ্রুববিন্দুও নেই কোনো। আমরা চেতনার ফসল নই কেবল, চেতনাকে নির্মাণও করি। সময়-স্বভাব আমাদের রূপান্তরপ্রবণ নির্মিতি-প্রকরণে প্রতিফলিত হচ্ছে। আর, এই নির্মাণের সূত্রে জন্ম নিচ্ছে নতুন নতুন উচ্চারণ আরো একবার বিনির্মিত হবে বলে। তাই মুক্ত ও স্বাধীন সঞ্চরণের প্রতীতি আমাদের সংযোগ প্রকরণে স্বতঃসিদ্ধ। আমরা যখন বাচনের প্রাকরণিক বিধির কথা বলি, তা কেবল নৈরাজ্যকে প্রতিহত করার জন্যে। কিন্তু এইসব বিধি অভ্যস্ত আকরণের সঙ্গে ভাষার নিরন্তর সংঘর্ষকে নিরাকৃত করতে পারে না। এই সংঘর্ষের সূত্রে আমরা পৌছে যাই বাচনের অন্তর্বৃত রাজনীতির ধারণায়।

৫১