পাতা:বাখতিন - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৫৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

বিচ্ছিন্ন একক ও ভ্রামণিক; স্বয়ংসম্পূর্ণ বলেই অন্য অংশের পক্ষে নিতান্ত পরবাসীর মতো সুদূর। দ্বিতীয় ধরনের ঐক্যে যান্ত্রিকতা নেই; বিভিন্ন অংশ পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হয় প্রতীতিতে, ধারণার নিরিখে। ব্যক্তি-অস্তিত্বের চিন্তন-প্রক্রিয়ায় যেমন বিবিধ উৎসজাত ভাববীজ সম্পৃক্ত হয়, প্রতিটি অংশ একে অপরের সম্পর্কে সংবেদনশীল এবং মিথষ্ক্রিয়ায় উন্মুখ। বাখতিন লক্ষ করেছেন, শিল্পে অভিব্যক্ত সময় ও পরিসর এমন-এক জগতের ইঙ্গিত দেয় যা বাস্তব অভিজ্ঞতায় প্রতিফলিত সময় ও পরিসর থেকে অনেক স্বতন্ত্র। এই দুইয়ের মধ্যে তিনি বিচ্ছেদ ভেবে নিয়েছেন: ‘When a man is in art, he is not in life and vice versa!’ তাঁর মতে, শিল্প-স্বভাবে এবং মানবব্যক্তিত্বের স্বভাবে কিছুই যথাপ্রাপ্ত নয়; তাই স্বতশ্চল ভাবে এদের মধ্যে তাৎপর্যপূর্ণ সম্পর্ক নিশ্চিত হয় না। সম্পর্ক গড়ে তুলতে হয়, দিতে হয় আকার ও চরিত্র, নির্দিষ্ট ধারণাভিত্তিক সমর্থন। মন যেহেতু নির্মিতি-নিপুণ কারুকৃৎ, শুধুমাত্র তারই প্রণালীবদ্ধ সক্রিয়তায় সৃষ্টি হয় ঐক্যবোধ। শিল্প ও জীবনের সম্পর্ক রচিত হয় তখনই যখন কোনো পর্যবেক্ষক মানুষ তা গড়ে তোলে। সম্পর্কের প্রতিষ্ঠা হওয়া সম্ভব যখন ঐ পর্যবেক্ষক উপস্থাপনার মধ্যে খুঁজে পায় প্রত্যুত্তর-সম্ভাবনা। আর, সম্ভাবনা মানে যোগ্যতা, অনবরত যোগ্য হয়ে ওঠা।

 শিল্পের প্রতিবেদন যেন প্রশ্নমালা আর জীবন সেইসব জিজ্ঞাসার সম্ভাব্য প্রত্যুত্তর। শিল্প থেকে যে-অভিজ্ঞতা ও প্রতীতি অর্জন করি, জীবনে তার জবাব দিয়ে যেতে হয়। নইলে জীবন উদ্ভাসিত হবে না। ব্যক্তিগত প্রত্যুত্তর-যোগ্যতার এই নন্দন সামূহিক ভূমিকার চেয়ে স্পষ্টত বেশি গুরুত্ব দেয় একক অস্তিত্বের সংগঠনকে। সেইসঙ্গে শিল্প ও জীবনের সম্পর্ক বিষয়ক চিরাগত ধারণা থেকে অনেক দূরে সরে যায়। নিঃসন্দেহে শিল্প এবং অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের সক্রিয়তা; তবে তাদের মধ্যে অন্তত একটি ক্ষেত্রে সাদৃশ্য রয়েছে। শিল্প-প্রকরণ সৃষ্টি বা জীবন-সৃষ্টির প্রক্রিয়া একে অপরের জটিল অস্তিত্ব উপেক্ষা করে নিজের কাজকে সরলীকৃত করতে চায়: ‘For it is certainly easier to create without answering for life and easier to live without any consideration for art. Art and life are not one, but they must become united in myself in the unity of my answerability’ (১৯৯৫: ২)।

 আমাদের অভিজ্ঞতা থেকেও বুঝি, শিল্প-সাহিত্যের স্রষ্টারা নান্দনিক দায়বোধের নামে জীবন থেকে উত্থাপিত প্রশ্নমালা সম্পর্কে নিরুত্তর থাকাকে গরীয়ান করেন। তেমনি শিল্প-সাহিত্য বিষয়ে পুরোপুরি উদাসীন থেকে জীবন নির্বাহ করাটা অধিকাংশ মানুষের কাছে সহজ ও স্বাভাবিক বলে বিবেচিত হয়। এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো খুব গুরুত্বপূর্ণ যে শিল্প ও জীবন এক নয়; কিন্তু গ্রহীতা সত্তার মধ্যে তাদের অন্যোন্য-সম্পৃক্ত হতেই হবে। এ কেবল আকাঙ্ক্ষা নয়, এ হলো ঔচিত্যের ঘোষণা। গ্রহীতার প্রত্যুত্তর-যোগ্যতা থেকে উৎসারিত ঐক্যবোধে শিল্প ও জীবন প্রকৃত তাৎপর্যপ্রসূ হয়ে ওঠে। জীবন সাবভৌম ও আত্মদীপ, শিল্প-ও তা-ই। কিন্তু তাদের প্রকাশ ও বিচ্ছুরণ, অবস্থান ও প্রতীতির প্রকরণে রয়েছে আপেক্ষিক স্বাতন্ত্র্য।

 মাত্র ছ’টি ছোট-ছোট অনুচ্ছেদে বিন্যস্ত এই বয়ান যেন চিন্তাসূত্র হিসেবে পরিবেশিত হয়েছে। পরবর্তী কালে যে গভীর মনন-ঋদ্ধ প্রতিবেদন রচিত হবে, বাখতিন এখানে যেন বীজাকারে তার মুখ্য ভাববস্তু উপস্থাপিত করেছেন। নিবিড় পাঠে অন্তর্বৃত অনেকান্তিকতা

৫৫