পাতা:বিভূতি রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড).djvu/১১২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

సెళి বিভূতি-রচনাবলী স্ববিশাল গালিচ কে যেন পাতিয়া গিয়াছে—এর কোথাও বাধা নাই, ছেদ নাই, জঙ্গলের সীমা হইতে একেবারে বহু, বহু দূরের চক্রবাল-রেখায় নীল শৈলমালার কোলে মিশিয়াছে। মাথার উপরে শীতকালের নিৰ্ম্মেঘ নীল আকাশ। এই অপরূপ শস্তক্ষেত্রের মাঝে মাঝে প্রজাদের কাশের খুপরি । স্ত্রী-পুত্র লইয়া এই দুরন্ত শীতে কি করিয়া তাহারা যে এই কাশউণটার বেড়া-ঘেরা কুটিরে এই উন্মুক্ত প্রাস্তরের মধ্যে বাস করে! ফসল পাকিবার সময়ের আর বেশী দেরি নাই । ইহার মধ্যে কাটুনী মজুরের দল নানাদিক হইতে আসিতে শুরু করিয়াছে। ইহাদের জীবন বড় অদ্ভুত,—পূর্ণিয়া, তরাই ও জয়ন্ত্রীর পাহাড়-অঞ্চল ও উত্তর ভাগলপুর হইতে স্ত্রী-পুত্র লইয়া ফসল পাকিবার সময় ইহারা আসিয়া ছোট ছোট কুঁড়েঘর নির্মাণ করিয়া বাস করে ও জমির ফসল কাটে—ফসলের একটা অংশ মজুরীস্বরূপ পায়। আবার ফসল কাটা শেষ হইরা গেলে কুঁড়েঘর ফেলিয়া রাখিয়া স্ত্রী-পুত্র লইয়া চলিয়া যায়। আবার আর বছর আসিবে । ইহাদের মধ্যে নানা জাতি আছে— বেশীর ভাগই গাঙ্গোত কিন্তু ছত্রী, ভূমিহার ব্রাহ্মণ পৰ্য্যন্ত আছে। এ-অঞ্চলের নিয়ম, ফসল, কাটিবার সময়ে ক্ষেতে বসিয়া খাজনা আদায় করিতে হয়—নয়ত এত গরীব প্রজা, ফসল ক্ষেত হইতে উঠিয়া গেলে আর খাজনা দিতে পারে না। খাজনা আদায় তদারক করিবার জন্য দিনকতক আমাকে ফুলকিয় বইহারের দিগন্তবিস্তীর্ণ শস্তক্ষেত্রের মধ্যে থাকিবার দরকার হইল। তহশীলদার বলিল—ওখানে তাহলে ছোট তাবুটা খাটিয়ে দেব ? —একদিনের মধ্যেই ছোট একটি কাশের খুপরি করে দাও না ? –এই শীতে তাতে কি থাকতে পারবেন হুজুর ? —খুব। তুমি তাই কর। তাহাই হইল। পাশাপাশি তিন-চারটা ছোট ছোট কাশের কুটির, একটা আমার শয়নঘর, একটা রান্নাঘর, একটাতে দুজন সিপাহী ও পাটোয়ারী থাকিবে! এ-ধরনের ঘরকে এদেশে বলে ‘খুপরি'—দরজা-জানালার বদলে কাশের বেড়ার খানিকটা করিয়া কাটা—বন্ধ করিবার উপায় নাই—হু-হু হিম আসে রাত্রে। এত নীচু যে হামাগুড়ি দিয়া ভিতরে ঢুকিতে হয়। মেঝেতে খুব পুরু করিয়া শুক্নে কাশ ও বন-ঝাউয়ের মুটি বিছানো—তাহার উপর • শতরঞ্জি, তাহার উপর তোশক-চাদর পাতির ফরাস করা। আমার খুপরিটি দৈর্ঘ্যে সাত হাত, প্রস্থে তিন হাত। সোজা হইয়া দাড়ানো অসম্ভব ঘরের মধ্যে, কারণ উচ্চতায় মাত্র তিন হাত । কিন্তু বেশ লাগে এই খুপরি। এত আরাম ও আনন্দ কলিকাতায় তিনচারতলা বাড়ীতে থাকিয়াও পাই নাই। তবে বোধ হয় আমি দীর্ঘদিন এখানে থাকিবার ফলে বন্ত হইয়া যাইতেছিলাম, আমার রুচি, দৃষ্টিভঙ্গি, ভাল-মন্দ লাগা সবেরই উপর এই মুক্ত অরণ্য-প্রকৃতির আল্প-বিস্তর প্রভাব আসিয়া পড়িয়াছিল, তাই এমন হইতেছে কিনা কে জানে। | খুপরিতে ঢুকিয়া প্রথমেই আমার ভাল লাগিল সদ্য-কাটা কাশ-ভাটার তাজা মুগন্ধটা, যাহা দিয়া খুপরির বেড়া বাধা । তাহার পর ভাল লাগিল আমার মাথার কাছেই এক বর্গহাত