পাতা:বিভূতি রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড).djvu/৪১৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ডাকগাড়ী এক এক সময় রাধা ভাবে কোথাও বেড়াইয়া আসিতে পারিলে ভালো হইত। আজ ছ' বছরের মধ্যে সে একখানা দুর্গ প্রতিমার মুখ পৰ্য্যন্ত দেখে নাই। এ গায়ে সবাই গরীব, দুর্গোৎসব তো দূরের কথা, তেমন একটা জাকের কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা পৰ্য্যন্ত হয় না। অবশু এ গায়েরই সে মেয়ে, এই অবস্থার মধ্যেই মানুষ হইয়াছে, বল্যে সে ভাবিত সৰ্ব্বত্রই বুঝি এই রকম ব্যাপার। কিন্তু বিয়ের পর বামুদেবপুর গিয়া রাধা প্রথম বুঝিল, তাদের গা অতি হীন অবস্থার গী। গরীব আর বড়লোকে তফাত কি, বুঝিল। বামুদেবপুর এমন কিছু শহর বাজার জায়গা নয়, গঙ্গার ধারে একখানা বর্ধিষ্ণু গ্রাম এই পৰ্য্যস্ত। সেখানে মুস্তফির বড় লোক, এমন পূজা নাই যে, তাদের বাড়ী হইত না—দুর্গোৎসব বল, শুমা পূজা বল, জগদ্ধাত্রী পূজা বল, এমন কি রথ পৰ্যন্ত । বছর তিনেক বড়ই আনন্দে কটিয়াছিল—সব দিক দিয়াই। তারপর তাহার স্বামী মারা গেল যকৃতের রোগে । শাশুড়ীর সঙ্গে রাধার বনিল না, দিনকতক উভয়ের মধ্যে যে সব বাক্যাবলীর আদান-প্রদান চলিল, তাহাকে ঠিক সদয় ও ভদ্রবাক্য বলা চলে না। রাধা প্রমাণ করিতে ব্যস্ত হইল, তাহার বাবা এত দরিদ্র আজও হন নাই যে, তাহাকে একবেল এক মুষ্টি আতপ চালের ভাত দিয়া পুষিতে পারবেন না। ফলে একদিন একটি মাত্র পুটুলি সম্বল করিয়া রাধা তাহার ছোট ভাইয়ের সঙ্গে বাপের বাড়ী আসিয়া পৌছিল। ভাইটিকে সে-ই পত্র লিখিয়া আনিয়াছিল। তাহার তোরঙ্গ ও ক্যাশবাক্স শাশুড়ী আটকাইয়া রাখিলেন। ছ' বছর তারপর কাটিয়, গিয়াছে । সেই যে বিধবা হইয়া আসিয়া বাপের বাড়ী চুকিয়াছে, আর সে গ্রাম হইতে বাহির হয় নাই । এই ছ' বছরে অনেক কিছু ঘটিয়া গেল তাঁহাদের সংসারে। বাবা লেখাপড় ভালো জানেন না, বিশ্বাসদের পাটের আডতে কাজ করিয়া সামান্ত কয়েকটি টাকা পাইতেন। বাবার সে চাকুরিটা গেল। রাধার ছোট একটা ভাই গেল মারা। বাবা বাত হইয়া কিছুদিন শয্যাগত থাকিলেন। বাবার সঙ্গে মাৰো মনোমালিন্তের স্বত্রপাত হইল। ক্রমে উভয়ের মধ্যে সামান্ত কথায় ঝগড়া বিবাদ হইতে লাগিল। জমিদার নালিশ করিয়া তাহদের বড় জমা ক্রোক করিয়া লইল, ইত্যাদি ইত্যাদি। একঘেয়ে হইয়া পড়িয়াছে দিনগুলি, সেই সংসারের কাজ, সেই গরুর সেবা, সেই রাধাবাড়া, বাবার হাতে পারে তেল মালিশ করা, মায়ের দোক্তার পাতা পুড়াইয়াতামাক তৈরি করা, কলের মতো একটানা একঘেয়ে ভাবে চলিতেছে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। আজ সকালে ডোবার ধারে বাসন মাজিতে বসিয়া তাই সে ভাবিতেছিল, একবারকোথাও বেড়াইয়া আসিবে।