পাতা:বেগম রোকেয়া রচনাবলী.pdf/৯৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

করিলেন। একটি কারচোবে রেশমের কাজ করা হইতেছিল। ভগিনী সারা জিজ্ঞাসা করিলেন আমিও সেলাই জানি কি না। আমি বলিলাম—

 ‘আমরা অন্তপুরে থাকি, সেলাই ব্যতীত অন্য কাজ জানি না।’

 ‘কিন্তু এদেশের অন্তঃপুরবাসীদের হাতে আমরা কারচোবের কাজ দিয়া নিশ্চিন্ত রহিতে পারি না।’ এই বলিয়া তিনি হাসিলেন, ‘পুরুষদের এতখানি সহিষ্ণুতা কই যে তাহারা ধৈর্যের সহিত ছুঁচে সূতা পরাইবে?’

 তাহা শুনিয়া আমি বলিলাম, ‘তবে কি কারচোবের কাজগুলি সব আপনিই করিয়াছেন?’ তাঁহার ঘরে বিবিধ ত্রিপদীর উপর নানাপ্রকার সলমা চুমকির কারুকার্যখচিত বস্ত্রাবরণ ছিল।

 তিনি বলিলেন, ‘হাঁ, এ-সব আমারই স্বহস্ত প্রস্তুত।’

 ‘আপনি কিরূপে সময় পান? আপনাকে তো অফিসের কাজও করিতে হয়, না? কি বলেন?’

 ‘হাঁ। তা আমি সমস্তদিন রসায়নাগারে আবদ্ধ থাকি না। আমি দুই ঘণ্টায় দৈনিক কর্তব্য শেষ করি।’

 ‘দুই ঘণ্টায়! আপনি এ কী বলেন?—দুই ঘণ্টায় আপনার কার্য শেষ হয়! আমাদের দেশে রাজকর্মচারীগণ—যেমন মাজিস্ট্রেট, মুন্সেফ, জজ প্রমুখ প্রতিদিন ৭ ঘণ্টা কাজ করিয়া থাকেন।’

 ‘আমি ভারতের রাজপুরুষদের কার্যপ্রণালী দেখিয়াছি। আপনি কি মনে করেন যে, তাহারা সাত-আট ঘণ্টাকাল অনবরত কাজ করেন?’

 ‘নিশ্চয়, বরং এতদপেক্ষা অধিক পরিশ্রমই করেন।’

 ‘না প্রিয় সুলতানা। ইহা আপনার ভ্রম। তাঁহারা অলসভাবে বেত্রাসনে বসিয়া ধূমপানে সময় অতিবাহিত করেন। কেহ আবার অফিসে থাকিয়া ক্রমাগত দুই-তিনটি চুরুট ধ্বংস করেন। তাঁহারা মুখে যত বলেন, কার্যত তত করেন না। রাজপুরুষেরা যদি কিছু করেন, তাহা এই যে, কেবল তাঁহাদের নিম্নতম কর্মচারীদের ছিদ্রান্বেষণ। মনে করুন একটি চুরুট ভস্মীভূত হইতে অর্ধঘণ্টা সময় লাগে, আর কেহ দৈনিক ১২টি চুরুট ধ্বংস করেন, তবে সে ভদ্রলোকটি প্রতিদিন ধূমপানে মাত্র ছয় ঘণ্টা সময় ব্যয় করেন।’

 তাই তো। অথচ ভ্রাতৃমহোদয়গণ জীবিকা অর্জন করেন, এই অহঙ্কারেই বাঁচেন না। ভগিনী সারার সহিত বিবিধ প্রসঙ্গ হইল। শুনিলাম, তাঁহাদের নারীস্থান কখনো মহামারী রোগে আক্রান্ত হয় না। আর তাঁহারা আমাদের ন্যায় হুলধর মশার দংশনেও অধীর হন না। বিশেষ একটি কথা শুনিয়া আমি অত্যন্ত বিস্মিত হইলাম—নারীস্থানে নাকি কাহারও অকাল-মৃত্যু হয় না। তবে বিশেষ কোনো দুর্ঘটনা হইলে লোকে অপ্রাপ্ত বয়সে মরে, সে স্বতন্ত্র কথা। ভগিনী সারা আবার হিন্দুস্থানের অসংখ্য শিশুর মৃত্যু সংবাদে অবাক হইলেন! তাঁহার মতে যেন এই ঘটনা সর্বাপেক্ষা অসম্ভব! তিনি বলিলেন, যে প্রদীপ সবেমাত্র তৈল সলিতা যোগে জ্বলিতে আরম্ভ করিয়াছে, সে কেন (তৈল বর্তমানে) নির্বাপিত হইবে। যে নব কিশলয় সবেমাত্র অঙ্কুরিত হইয়াছে, সে কেন পূর্ণতা প্রাপ্তির পূর্বে ঝরিবে!

 ভারতের প্লেগ সম্বন্ধেও অনেক কথা হইল, তিনি বলিলেন, ‘প্লেগ-টেলেগ কিছুই নহে—কেবল দুর্ভিক্ষ প্রপীড়িত লোকেরা নানা রোগের আধার হইয়া পড়ে। একটু

■ ১০৭ ■