পাতা:ভারতকোষ - প্রথম খণ্ড.pdf/৭৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
অনশনব্রত
অনাক্রম্যতা

ধর্মসংক্রান্ত ব্যাপারে অনশনের ব্যবস্থা থাকিলেও ধর্মই অনশনের একমাত্র কারণ হইতে পারে না। সম্ভবতঃ ইহার উৎপত্তির কোনও একটিমাত্র নির্দিষ্ট কারণ নাই। শুদ্ধীকরণ, প্রায়শ্চিত্ত, শোকানুষ্ঠান, সমবেদনা জ্ঞাপন, কামনা-বাসনা পূরণ, দীক্ষা, জাদুবিদ্যা ও বিশেষ শক্তিলাভ প্রভৃতি বহু কারণে অনশনব্রত পালনের রীতি প্রচলিত। ইহা ব্যতীত বহু প্রাচীন কাল হইতে সন্ন্যাসজীবনে অনশনব্রত পালন অবশ্য কর্তব্য রূপে গণ্য হইয়া আসিতেছে।

বিভিন্ন ধর্মমতেও অনশনব্রত পালনের বিধান রহিয়াছে। মহাযান বৌদ্ধেরা অনশনের পক্ষপাতী ছিলেন। চীনের তাও ধর্ম (Taoism) অনশনকে ইহার অঙ্গস্বরূপ বলিয়া গণ্য করে। ইহুদীগণও ধর্মকার্যে ও প্রায়শ্চিত্তে (Day of Atonement) অনশনব্রত পালন করিয়া থাকেন। যীশুখ্রীষ্ট স্বয়ং অনশন করিয়াছিলেন (St. Luke iv. 2 seq.) ও অনশনকে ধর্মের অঙ্গ হিসাবে গ্রহণ করিতে অনুগামীদিগকে নির্দেশ দিয়াছিলেন (St. Mark ii, 19 seq.; St. Matthew vi. 16 seq.)। জরথুস্ত্রীয় ধর্মে উপবাস পাপ বলিয়া গণ্য কিন্তু কেহ মরিলে জরথুস্ত্রীয়েরা তিন রাত্রি অনশন করিয়া থাকেন। জৈনদের মধ্যে অনশনব্রত প্রায় প্রত্যেক ধর্মকর্মের অঙ্গস্বরূপ। ধর্মকার্যে অনশন ব্যতীত অনশনব্রত অবলম্বন করিয়া মৃত্যুবরণেরও বিধান রহিয়াছে। জৈনদের এই আমৃত্যু অনশন ত্রিবিধ—ভক্তপ্রত্যাখ্যান, ইঙ্গিনী ও পাদপোপগমন। ভক্তপ্রত্যাখ্যানে অনশনকারী চলিতে পারেন ও ইচ্ছা করিলে জলপান করিতে পারেন, ইঙ্গিনীতে নির্দিষ্ট স্থানের মধ্যে চলিতে বাধা নাই কিন্তু অনশনকারীকে নিরম্বু উপবাস করিতে হয়। আর পাদপোপগমন আমৃত্যু নিশ্চল নিরম্বু অনশন। মৃত্যু সংকল্প করিয়া এক, দুই, তিন, সাত, নয়দিনব্যাপী অথবা একমাসব্যাপী অনশনের নির্দেশ শাস্ত্রে দেওয়া হইয়াছে। গরুড়পুরাণে শ্রীকৃষ্ণ গরুড়ের প্রতি উপদেশ প্রসঙ্গে বলিয়াছেন, যে ব্যক্তি অনশন করিয়া প্রাণত্যাগ করে সে বিষ্ণুতুল্য হয়, অনশন-ব্রত অবলম্বন করিয়া যতদিন জীবিত থাকে তাহার প্রত্যেক দিন স-দক্ষিণ-ক্রতু দিবসতুল্য হইয়া থাকে (৩৬।৫-৬)। ইহা ব্যতীত অগ্নিপুরাণ, মৎস্যপুরাণ, আপস্তম্ব শ্রৌতসূত্র, মনুসংহিতা, যাজ্ঞবল্ক্যসংহিতা, বশিষ্ঠসংহিতা, অত্রিসংহিতা, বিষ্ণুসংহিতা প্রভৃতি পুরাণ ও ধর্মগ্রন্থে অনশনব্রত পালনের বিধি-বিধান রহিয়াছে।

বঙ্গীয় মহাকোষ।

কৃষ্ণময় ভট্টাচার্য

অনাক্রম্যতা রোগ-বীজাণু শরীরে প্রবেশ করা সত্ত্বেও যদি রোগের আক্রমণ না ঘটে, তবে সেই অবস্থাকে অনাক্রম্যতা বলা হয়। অনাক্রম্যতা দুই রকমের, ১. স্বাভাবিক ২. কৃত্রিম অর্থাৎ অর্জিত। অনেক ক্ষেত্রে মানুষ স্বাভাবিক অনাক্রম্যতা লইয়াই জন্মগ্রহণ করে। কোনও কোনও লোকের এক বা একাধিক রোগের বিরুদ্ধে অনাক্রম্যতা থাকে। সংখ্যায় অল্প হইলেও কোনও কোনও ব্যক্তির প্রায় সকল রকম রোগ-বীজাণুর বিরুদ্ধেই অনাক্রম্যতা দেখা যায়। কিন্তু আমাদের জীবৎকালের মধ্যে রোগের আক্রমণের বিরুদ্ধে যদি অনাক্রম্যতা অর্জন করা যায়, তাহাকে কৃত্রিম বা অর্জিত অনাক্রম্যতা বলে। ইহা বিভিন্ন উপায়ে সম্ভব। বীজাণুঘটিত কোনও রোগে আক্রান্ত হইবার পর কেহ যদি আরোগ্য লাভ করে, তবে ভবিষ্যতে তাহার সেই রোগে আক্রান্ত হইবার সম্ভাবনা থাকে না। আবার ইন্‌জেক্‌শন বা টিকার সাহায্যে শরীরের মধ্যে কোনও পদার্থ প্রবেশ করাইয়াও অনাক্রম্যতা লাভ করা যায়।

মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর শরীর এমন ভাবেই গঠিত যে, কোনও বিষাক্ত পদার্থ ভিতরে প্রবেশ করিলেই তাহাকে বিষ-প্রতিরোধক পদার্থ উৎপাদনে উত্তেজিত করে এবং সেই পদার্থই বহিরাগত বিষকে প্রতিরোধ করে। রোগোৎপাদক বীজাণু কর্তৃক উৎপাদিত বিষকে বলা হয় টক্সিন, আর এই বিষক্রিয়া প্রতিরোধের জন্য শরীরের মধ্যে যে পদার্থ উৎপন্ন হয়, তাহাকে বলে অ্যাণ্টিটক্সিন। গবেষণার ফলে জানা গিয়াছে—বিষের প্রভাব হইতে শরীরকে রক্ষা করিবার জন্য এই সকল পদার্থ রক্তের গ্লোবিউলিন হইতে উৎপন্ন হইয়া থাকে। যেমন—ডিপথেরিয়া টক্সয়েডকে (বিশুদ্ধীকৃত লবণজলে দ্রবীভূত ডিপথেরিয়া টক্সিন) সুস্থ শরীরে ইন্‌জেক্‌শন করিলেই অ্যাণ্টিটক্সিন উৎপন্ন হইতে থাকে এবং ইহাই এই রোগের বিরুদ্ধে শরীরকে অনাক্রম্য করিয়া তোলে।

শরীরের মধ্যে ইন্‌জেক্‌শনের সাহায্যে অ্যাণ্টিটক্সিন বা প্রতিবিষ প্রবেশ করাইয়া যে অনাক্রম্যতার সৃষ্টি করা হয়, তাহা নিষ্ক্রিয় বা প্যাসিভ; কারণ শরীর সেই অ্যাণ্টিটক্সিনকে নিষ্ক্রিয়ভাবে গ্রহণ করে। অন্যান্য পন্থায় সৃষ্ট অনাক্রম্যতাকে বলা হয় সক্রিয়; কারণ এই ব্যবস্থায় শরীর নিজেই অ্যাণ্টিটক্সিন প্রস্তুত করিতে সচেষ্ট হয়। নিষ্ক্রিয় অনাক্রম্যতা সাধারণতঃ এক বৎসরের বেশি স্থায়ী হয় না। সক্রিয় অনাক্রম্যতা দীর্ঘকাল স্থায়ী হইয়া থাকে—এমন কি, রোগাক্রান্ত ব্যক্তির রোগমুক্তির পরও
৫০