বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত.pdf/১৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

বোধ হয়, তুমিও আমাকে কিছুদিন স্মরণ রাখিবে। যদি রাখ, যতনি নরেন্দ্রের জন্যে তোমার স্নেহ থাকিবে, ততদিন এক মাধবীকঙ্কনটি রাখিও, যখন অভাগাকে ভুলিয়া যাইরে, নদীজলে শুষ্কলতা ফেলিয়া দিও।”

 শোকবিহ্বলা দগ্ধহৃদয়া হেমলতা বিস্মিত হইয়া নরেন্দ্রের দিকে চাহিয়া দেখিল, নরেন্দ্র স্থির। নরেন্দ্রের স্বর গম্ভীর ও অকম্পিত। নরেন্দ্রের চক্ষুতে জল নাই, কিন্তু অগ্নি জলিতেছে। ধীরে ধীরে হেমের হাত ছাডিয়া নরেন্দ্র চলিয়া গেল। সে অন্ধকার রজনীতে আর নরেন্দ্রকে দেখা গেল না।


॥ ছয়॥

 সায়ংকালীন অবকারাচ্ছন্ন গঙ্গাতীরে বসিয়া একটি ত্রয়োদশবর্ধীয়া বালিকা অসংখ্য উর্মিরাশির দিকে কি জন্য চাহিয়া রহিয়াছে? যতদূর অন্ধকারে দেখা যায় বীচিমালা উঠিতেছে, পড়িতেছে, তাহার পর একটি ঈষৎ ধূসর রেখা, তাহার পর আর অন্ধকারে দেখা যায় না। দেখিতে দেখিতে হেমের চক্ষু জলে পরিপূর্ণ হইল, হেম কিছু দেখিতে পাইল না। রজনী গাঢ় হইয়া আসিল, ক্রমে আকাশে তারা ফুটিতে লাগিল, তথাপি হেমের দেখা শেষ হইল না।

 রজনীতে জমিদারের বাড়ির সকলে নিদ্রিত হইল। হেমলতার পক্ষে সে রজনী কী ভীষণ! বালিকা ধীরে ধীরে শয্যা হইতে উঠিয়া গবাক্ষের নিকট আসিল, ধীরে ধীরে গবাক্ষ উদঘাটন করিয়া বাহিরে দেখিল; তারা-পরিপূর্ণ অন্ধকার আকাশের নীচে বিশাল গঙ্গা অনন্তস্রোতে ভাসিয়া যাইতেছে। সেই নৈশ-গঙ্গার দিকে দেখিতে দেখিতে কি হৃদয়বিদায়ক ভাব হেমলতার হৃদয়ে জাগরিত হইতে লাগিল। বাল্যকালের ক্রীড়া, কিশোর-বয়সের প্রথম ভালবাসা, কত কথা, কত কৌতুক একে একে জাগরিত হইয়া বালিকায় দলিত করিতে লাগিল। এক একটি কথা মনে হয়, আর হৃদয়ে দুঃখ উথলিয়া উঠে, অবিরল অশ্রুধারায় চক্ষু ও বক্ষঃস্থল ভাসিয়া যায়। আবার বালিকা শান্ত হইয়া গঙ্গার দিকে দেখে, আবার একটি কথা স্মরণ হয়, শোকবিহ্বলা হইয়া অজস্র রোদন করে; কাঁদিয়া কাঁদিয়া বালিকা অবসন্ন হইল, হায়! সে ক্রন্দনের শেষ নাই, সে ক্রন্দন অবারিত অশান্তিপ্রদ। রজনী একপ্রহর, দ্বিপ্রহর হইল, তথাপি বালিকা গবাক্ষর নিকট দণ্ডায়মানা অথবা ভূমিতে লুষ্ঠিত হইয়া নীরবে রোদন করিতেছে।

 শোকের প্রথম বেগের উপশম হইল, কিন্তু শোকচিন্তা-পরম্পরা নিবারণ হইবার নহে। গণ্ডস্থলে হাত দিয়া একাকিনী গবাক্ষপার্শ্বে বসিয়া হেমলতা ভাবিতে লাগিল। এক একবার হেমলতার নয়নে একবিন্দু জল আসিতে লাগিল, ধীরে ধীরে সেটি গড়াইয়া পড়িল

১৭

 মাধবীকঙ্কণ—২