বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত.pdf/২১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 প্রথম শোক ও নৈরাশ্যের বেগ তখন শান্তু হইয়াছে, নরেন্দ্র হেমলতাকে ফিরিয়া পাইবার উপায় চিন্তা করিতে লাগিলেন। অনেক ভাবিয়া-চিন্তিয়া স্থির করিলেন যে, সুবাদারের নিকট আপন বিষয় পাইবার আবেদন করিব। পৈতৃক জমিদারী আমার হইলে স্বার্থপর নবকুমার অবশ্যই আমাকে কন্যাদান করিবেন।

 এই উদ্দেশ্যে নরেন্দ্র সুবাদার সুজার রাজধানীতে পৌছিলেন। সম্রাট শাজাহানের পুত্র সুজা বঙ্গদেশের শাসনকার্যে নিযুক্ত হইয়া রাজধানী ঢাকা হইতে রাজমহলে স্থানান্তরিত কবিয়াছিলেন এবং বিংশতি বৎসর সুশাসন দ্বারা বঙ্গদেশে যথেষ্ট সুখ্যাতি লাভ করিয়াছিলেন। তাঁহার শাসনকালে দেশে প্রায় যুদ্ধ বা কোনরূপ উপদ্রব হয় নাই, প্রজাবর্গ নিরুদ্বেগে কালযাপন করিতেছিল। ইতিহাসে তাহার অনেক সুখ্যাতি দেখিতে পাওয়া যায়। তিনি যুদ্ধে যেরূপ বিক্রমশালী ছিলেন, অন্য সময়ে সেইরূপ ন্যায়পরায়ণ ও দয়ালু ফিলেন। তাহার দয়া ও ন্যায়পরতা দেখিয়া সমগ্র বঙ্গদেশে কি জমিদার, কি জায়গীরদার সকলেই তাহাকে ভালবাসিত। কথিত আছে, তাহার মুত্যুর সময়ে আবালবৃদ্ধবনিতা সকলেই তাহার জন্য খেদ করিয়াছিল; কিন্তু তাহার উদারস্বভাব দুই একটি দোষে কলঙ্কিত ছিল। যুদ্ধের সময় তিনি যেরূপ সাহসী, অন্য সময়ে তিনি সেইরূপ বিলাসী। সুজা নিরতিশয় সুশ্রী পুরুষ ছিলেন এবং সর্বদাই সুন্দরী রমণীমণ্ডলীতে পরিবৃত থাকিতে ভালবাসিতেন। তাহার প্রধানা রাজ্ঞী প্যারীবানু বঙ্গদেশে রূপে, গুণে ও চতুরতায় অদ্বিতীয়া বলিয়া খ্যাতা ছিলেন। তিনি বাক্‌পটুতা ও সুমধুর কৌতুকে সর্বদাই সুবাদারের হৃদয় প্রেমরসে সিক্ত করিয়া রাখিতেন। কিন্তু প্যারীবানুও সুজার একমাত্র প্রণয়ভগিনী ছিলেন না, শত শত বেগম উদ্যানস্থিত পুষ্পের ন্যায় সুজার রাজমন্দির আলো করিয়া থাকিত। তাহাদের রূপে বিমোহিত হইয়া সুজা রাজকার্য বিস্মৃত হইতেন, কখন কখন দুই তিন দিন ক্রমান্বয়ে মদ্যপান ও আমোদে অতিবাহিত করিতেন।

 নরেন্দ্রনাথ সুবাদারের নিকট আবেদন করিতে যাইলেন। এরূপ সুবাদারের নিকট উচিত বিচার প্রত্যাশা সম্ভব নহে। গঙ্গাতীরে সুন্দর রাজমহল নগরী এখনও দেখিতে মনোহর, কিন্তু যখন বঙ্গদেশের রাজধানী ছিল, তখন রাজমহলের শোভা অতুলনীয় ছিল। সুবারের উচ্চ প্রাসাদ ও রাজবাটা, ওমরাহ ও জায়গীরদারদিগের সুদৃশ্য হর্ম্যাবলী এবং বঙ্গদেশের সমস্ত ধনাঢ্য লোকের সমাগমে রাজমহল যথার্থ রাজপুরী বোধ হইত। স্বয়ং গঙ্গা সহ ধন্য বণিকের সহস্র পোত বক্ষে ধারণ করিয়া নগরের শোভা ও সমৃদ্ধি বর্ধন করিত। প্রশস্ত রাজপথে যুদ্ধবিলাসী গর্বিত ওমরাহ ও মুসলমান জমিদারগণ সর্বদাই অশ্ব, হস্তী অথবা শিবিকায় গমন করিত।

২১