বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত.pdf/৫০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 এইরূপ দুর্গ দেখিতে দেখিতে সৈন্যের শেষে একদিন সন্ধ্যার সম্ম চিতোরের দুর্গের নিকট আসিয়া উপস্থিত হইল। সৈন্যরা আহারাদি সমাপ্ত করিয়া আপন আপন শিবিরে বিশ্রাম করিতে গেল কিন্তু নরেন্দ্র কতিপয় রাজপুতের সহিত চিতোর পর্বতে উঠিয়া তাহার উপরিস্থ দুর্গে ভ্রমণ করিতে লাগিলেন। নরেন্দ্র বিস্মিত নয়নে কুম্ভ রাজার সুন্দর স্তম্ভ দেখিলেন, পদ্মিনী রাজ্ঞীর প্রাসাদে ও সরোবর দেখিলেন, যে সিংহদ্বারে রাজপুত যোদ্ধগণ বার বার অসিহস্তে জীবনদান করিয়াছেন, তাহা দেখিলেন, যে চিতায় রাজপুত- রমণীগণ চিতারোহণ কুল মান রক্ষা করিয়াছেন, সেই চিতার গহ্বর দেখিলেন।

 সহসা তাঁহাদের সম্মুখে একজন বৃদ্ধ মনুষ্য আসিয়া উপস্থিত হইলেন। রাজপুতদিগের মধ্যে কেহ কেহ তাহাকে চিনিতে পারিলেন, তিনি চিতোরের পুরাতন ‘চারণ'। চারণগণ। পূর্বকালে রাজপুতানার রাজাদিগের গৌরবগীত গাহিয়া রাজপুরুষ ও নগরবাসীদের মনোরঞ্জন করিতেন; রাজপুতানায় এখন পর্যন্ত সন্ধ্যার সময়ে লোকে সমবেত হইয়া চারণের গীত শুনিতে ভালবাসে, পূর্ব-গৌরবগান শুনিতে শুনিতে তাহাদিগের নয়ন বীরশ্রুতে আপ্লুত হয়।

 নরেন্দ্র ও তাঁহার সঙ্গী রাজপুতগণ চারণকে একটি শিলার উপর বসাইলেন ও আপনারা চারিদিকে বলিয়া প্রতাপসিংহের গান শুনিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিলেন। চারণ সেই গান আরম্ভ করিলেন।

 “রাজপুতগণ। এটি আমার গীত নহে, অম্বর গর্জন-প্রতিঘাতী পর্বতশৃঙ্গের গীত, বজ্রনাদ জলপ্রপাতের গীত, তোমরা শ্রবণ কর। যে পর্বতকন্দরে একজন রাজপুতসেনার অস্থি পড়িয়া রহিয়াছে, সেই গহ্বর হইতে এই গীত বহির্গত হইতেছে। যে পূর্বতরঙ্গ বাহিনীর জল রাজপুতের একবিন্দু শোণিতেও আরক্ত হইয়াছে, সেই তটিনীর কুলে এই ধ্বনিত হইতেছে। প্রতাপসিংহ। এটি তোমার গীত।

 ঐ দেখ, আকবরের ভীষণ প্রতাপে সমগ্র ভারতবর্ষ কম্পিত হইতেছে, কিন্তু প্রতাপের হৃদয় কম্পিত হইল না। চিতের নগর আর তাহার নাই, তাঁহার পিতার রাজত্বকালে নিষ্ঠুর আকবর চিতোর কাড়িয়া লইয়াছেন। দুর্গক্ষোর্থ জয়মল্ল জীবন দিয়াছিল, পড়ে মাতা ও বনিতা স্বহস্তে যুদ্ধ করিয়া জীবাদান করিয়াছিল, তথাপি রাজপুতের বক্ষস্থল বিদীর্ণ করিয়া আকবর চিতোর কাড়িয়া লইলেন। প্রতাপ যখন রাজা হইলেন, তখন চিতোর নাই, সৈন্য নাই, অর্থ নাই, কিন্তু তাহার বীরান্তঃকরণ ছিল, বীরের দুঃসাধ্য কি আছে? প্রবলতাপাদ্বিত রাজপুতরাজগণ দিল্লীর দাসত্ব স্বীকার করিলেন, প্রতাপ করিলেন না। অম্বরের ভগবানদাস ও মাড়ওয়ারের মল্লদেব নিজ নিজ দুহিতাকে দিল্লীর সম্রাটহস্তে অৰ্পণ করিলেন, মহানুভব প্রতাপ ম্লেচ্ছের কুটুম্ব হইতে অস্বীকার করিলেন। কেন

৫০