পাতা:মুর্শিদাবাদ কাহিনী.djvu/১০২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
৯৬
মুর্শিদাবাদ-কাহিনী


মুর্শিদাবাদ-কাহিনী সিরাজের নিকট একথা নিজমুখে ব্যক্ত করিয়া গিয়াছেন। তিনি স্পষ্টই বলিয়াছেন যে, তাহার জীবন যুদ্ধে ও সামরিক কৌশলেই অতিবাহিত হইয়াছে। আলিবর্দী খাঁর। সমরক্ষেত্রে অবস্থানকালে তাহার বেগম এবং জ্যেষ্ঠ ভ্রাতুস্পুত্র ও জামাতা নওয়াজে মহম্মদ খার প্রতি মুর্শিদাবাদ রক্ষার ভার থাকিত। নওয়াজেস মহম্মদ খা ঁঢাকার শাসনকর্তার পদে নিযুক্ত ছিলেন। কিন্তু তাহাকে অধিকাংশ সময়েই মুর্শিদাবাদে বাস করিতে হইত; তাহার সহকারী হোসেনকুলী খাঁর প্রতি ঢাকার শাসনভার ন্যস্ত ছিল। হোসেনকুলী খাঁর মৃত্যুর পর রাজা রাজবল্লভ উক্ত পদে নিযুক্ত হন। নওয়াজে মহম্মদ খাঁ অত্যন্ত বিলাসী ও আমোদপ্রিয় ছিলেন। মুর্শিদাবাদের মধ্যস্থিত স্বীয় প্রাসাদ তাহার সর্বদা ভাল লাগত না। এই সময়ে আলিবর্দী খাঁ সিরাজউদ্দৌলাকে রাজ্যভার দিবেন বলিয়া প্রকাশ করিলে, তাহার পরিবারমধ্যে ভীষণ মনোেবিবাদ উপস্থিত হয়। সিরাজ ধীরে ধীরে আপনার প্রভুত্ব বিস্তার করিতেছিলেন। নওয়াজেস সিরাজের প্রভুত্ব অসহ্য বিবেচনা করিয়া রাজধানী হইতে কিছু দূরে অবস্থিতি করিতে ইচ্ছা করেন। তৎকালে মহারাষ্ট্রীয়দিগের ভয়ও প্রবল ছিল; তাহার দুই-একবার মুর্শিদাবাদ লুণ্ঠনও করে; সুতরাং তিনি একটি সুরক্ষিত স্থানের অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন। মোতিঝিলের সুন্দর অবস্থান দেখিয়া তাহার আশা পূর্ণ হইল। অশ্বপদাকার ঝিল ইহার তিন দিক্‌ বেষ্টন করিয়া রহিয়াছে; অধিকন্তু এই স্থানটি পরম রমণীয়, এই সকল বিবেচনায় তিনি ইহার তীরে স্বীয় প্রাসাদনির্মাণের আয়োজন করিতে আরম্ভ করিলেন।

 বাঙ্গলার প্রাচীন রাজধানী গৌড়ের অগণ্য ভগ্নস্তুপ হইতে প্রস্তরস্থূপ ও মর্মর প্রস্তর আনীত হইয়া প্রাসাদ নির্মিত হইল। কয়েকটি চত্বরে ভবনটি বিভক্ত হয়; চত্বরগুলি পরস্পর অল্প ব্যবধানে অবস্থিত ছিল; প্রত্যেক চত্বর দুইটি বৃহৎ প্রাচীরে বেষ্টিত ছিল, প্রাচীরগুলি প্রত্যেক দিকেই ঝিলের জল স্পর্শ করিত। দুই তিন শ্রেণীর লঘুকায় স্তম্ভ দ্বারা চত্বরের ছাদ সুরক্ষিত হইয়াছিল; কিন্তু প্রাসাদের গৃহগুলি তাদৃশ সুবিস্তৃত ছিল না। তৎকালে মুসলমানদিগের গৃহ প্রায়ই সুবিস্তৃত হইত না। অনেকস্থলে এখনও তাহার প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রাসাদের সোপানাবলী সলিলাভ্যন্তরে প্রবেশ করিয়াছিল। প্রাসাদের চারিদিকে নানাবিধ বৃক্ষ রোপণ করিয়া একটি রমণীয় কানন নির্মাণ করা হয়। ফলপুষ্পে শোভমান, বৃক্ষরাজিসমন্বিত রম্যকাননের মধ্যস্থ, জলমধ্যগত সোপানবলীসংলম সুচারু প্রাসাদটি পরপার হইতে দেখিলে বোধ হইত, যেন উদ্যানসহিত প্রাসাদটি ঝিলমধ্য হইতে ভাসিয়া উঠিতেছে।

 নওয়াজে মহম্মদ খাঁ প্রায়ই এই রম্য প্রাসাদে বাস করিতেন। তিনি ইহাতে কোকিলকণ্ঠী কামিনীগণের সঙ্গীতসুধাপানে অনেক সমরে পরিতৃপ্ত হইতেন। ভগবাই নামে একটি রমণী তাহার হৃদয় অধিকার করিয়াছিল। তাহার মনস্তুষ্টির জন্য তিনি অনেক অর্থ ব্যয় করেন এবং তাহাকে বিস্তর হীরা জহরত উপহার দিয়াছিলেন। তাহার সহিত এই মোতিঝিলের রম্য প্রাসাদে তিনি অনেক সময় অতিবাহিত