পাতা:মুর্শিদাবাদ কাহিনী.djvu/১০৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
৯৮
মুর্শিদাবাদ-কাহিনী


উদ্দৌলাকে তিনি প্রাণ অপেক্ষাও অধিক ভালবাসিতেন। এক্ৰাম উদ্দৌলার বসন্তরোগে প্রাণবিয়োগ হইলে, তাহাকে মোতিঝিলের মসজেদ-প্রাঙ্গণে সমাহিত করা হয়। নওয়াজে মহম্মদ খাঁ এক্রামের শোকে উন্মত্ত হইয়া উঠেন; বাস্তবিকই তৎকালে তিনি হিতাহিত-জ্ঞান-বর্জিত হইয়াছিলেন। তাহার ধীর প্রকৃতি অস্থির হইয়া উঠিল, জগতের সকল কার্যে তিনি বিরক্তি প্রকাশ করিতে লাগিলেন। তাহার প্রণয়নী ঘসেটি বেগম ও পূজ্যপাদ পিতৃব্য আলিবর্দী খাঁ কিছুতেই তাহাকে শান্ত করিতে পারিলেন না; ক্রমে তিনি ভয়ঙ্কর শোথরোগে আক্রান্ত হইয়া পড়েন। আলিবর্দী তাহাকে নিজ প্রাসাদে লইয়া গিয়া সুচিকিৎসকের হস্তে অর্পণ করিলেন, | কিন্তু কিছুতেই ফলোদয় হইল না। ঘসেটী বেগম সিরাজউদ্দৌলার ভয়ে পুনর্বার তাহাকে নগরমধ্যস্থ স্বীয় প্রাসাদে লইয়া গেলেন। তথায় হিজরী ১৯৬৯ অব্দে (১৭৫৫৫৬ খ্রীঃ অব্দে) তিনি চিরদিনের জন্য চক্ষু মুদ্রিত করিলেন। তাহার ইচ্ছানুসারে তাহার প্রিয়তম এক্রামের পার্শ্বে মোতিঝিলের মসৃজেদ-প্রাঙ্গণে নওয়াজেকে সমাহিত করা হয়। তাঁহাকে সমাধিস্থিত করার কথা মুতাক্ষরীনে এইরূপ বণিত হইয়াছে,—

 “প্রভাত হইতে না হইতে আনিশ্রেষ্ঠ মীর মহম্মদ আলি, আলিবর্দী খাঁ স্বয়ং, তাঁহারা পরিবারস্থ যাবতীয় আত্মীয়-স্বজন এবং নগরের স্ত্রী-পুরুষ অসংখ্য লোক মৃতদেহের সৎকারে উপস্থিত হইল। মুসলমান শাস্ত্রানুসারে মৃতদেহ ধৌত হইলে, জানাজী (শাস্ত্রীয় প্রার্থনা) পাঠের পর শব বহন করিয়া, মধ্যে মধ্যে স্কন্ধ বিনিময় করিতে করিতে, তাঁহারা তাহার প্রিয় গ্রাম্যভবন মোতিঝিলে উপস্থিত হইল। তথায় কিছুক্ষণ তাহার স্ব-নির্মিত মসৃজেদে মৃতদেহ রাখিয়া তাহারই প্রাঙ্গণে, এক্সাম উদ্দৌলার পার্শ্বে তাহাকে সমাহিত করিল। যে সময়ে তাঁহারা সমাহিত করিবার জন্য ভূমি হইতে মৃতদেহ উত্তোলন করে, সেই সময়ে সেই অসংখ্য নর-নারীর মধ্য হইতে ঈদৃশ রোদন ও শোকের ধ্বনি উঠিয়াছিল যে, তাহাতে যেন আকাশ বিদীর্ণ হইবার উপক্রম হইল। এইরূপ ঘটনা পূর্বে কখনও দৃষ্ট বা শুত হয় নাই।”[১]

 নওয়াজেস মহম্মদ খাঁর মৃত্যুর পর তাহার প্রণয়িনী ঘসেটী বেগম আপনার যাবতীয় সম্পত্তি লইয়া মোতিঝিলের প্রাসাদে অবস্থিতি করিতেছিলেন। এই সময়ে আলিবর্দী খাঁ মৃত্যুশয্যায় শায়িত হন। ঘসেটী বেগম সিরাজের উপর সন্তুষ্ট ছিলেন না। তিনি জানিতেন যে, আলিবর্দীর মৃত্যুর পর সিরাজই বাঙ্গালা, বিহার, উড়িষ্যার সিংহাসনে উপবিষ্ট হইবেন। ঘসেটী আত্মরক্ষার ও সিরাজের সিংহাসনারোহণে বাধাপ্রদানের জন্য পরলোকগত স্বামীর সৈন্যদিগকে হস্তী ও লক্ষ মুদ্রা প্রদান করিয়া বদ্ধপরিকর হইতে অনুরোধ করেন। প্রায় দশ সহস্র সৈন্য প্রতিজ্ঞাপূর্বক একবাক্যে তাহার জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইতে কৃতসঙ্কল্প হইল। হোসেনকুলী খাঁর মৃত্যুর

  1. Mutaqherin, Vol. I, p. 651.