পাতা:মুর্শিদাবাদ কাহিনী.djvu/১১১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
হীরাঝিল
১০৫

দেখিলে, মনঃপ্রাণ প্রফুল্ল হইয়া উঠিত। এই সুন্দর প্রাসাদে সিরাজ যৌবনসুলভ আমোদোপভোগ করিতে আরম্ভ করেন। আলিবর্দী খাঁর সহিত প্রতিনিয়ত অবস্থান করায়, তাঁহার বিলাসোপভোগের তাদৃশ সুযোগ ঘটিয়া উঠিত না; এজন্য হীরাঝিলের প্রাসাদে সেই পিপাসা মিটাইতে তাঁহার অত্যন্ত ইচ্ছা হয়। দিব্যাঙ্গনাতুল্য কোকিলকণ্ঠী নর্তকীবৃন্দ লইয়া তিনি সেই প্রাসাদে বিলাসতরঙ্গে ভাসমান থাকিতেন এবং আসবপানে বিভোর হইয়া তাহাদের মধুর সঙ্গীতে অধিকতর আবিষ্ট হইয়া পড়িতেন। সিংহাসনপ্রাপ্তির পূর্বে, মাতামহের অনুরোধে, সিরাজ সুরাপান পরিত্যাগ করিয়াছিলেন বটে, কিন্তু তিনি যৌবনারম্ভে অত্যন্ত সুরাসক্ত ছিলেন। কখনও বা মোসাহেব ও অনুচরবর্গের তোষামোদবাক্যে এবং বিদূষক বা কাহিনীকথকদিগের রহস্যালাপে বিমল আনন্দ অনুভব করিতেন। সময়ে সময়ে নর্তকী ও মোসাহেববৃন্দ লইয়া সুসজ্জিত সাধের তরণীতে আরোহণপূর্বক হীরাঝিলের স্বচ্ছ সলিলরাশি আন্দোলিত করিয়া বেড়াইতেন। জ্যোৎস্নাবিধৌত যামিনীতে ঝিলবক্ষোবিহারিণী তরণী হইতে যখন নর্তকীগণের কণ্ঠধ্বনি দিগন্ত স্পর্শ করিতে ধাবিত হইত, তখন তাহদের মধুর চুম্বনে ভাগীরথীর তরঙ্গলহরীও যেন মূর্ছিত হইয়া তীরক্রোড়ে ঢলিয়া পড়িত।

 এই প্রাসাদেই সিরাজউদ্দৌলা তাহার মনোমোহিনী ফৈজীর রূপসুধা পান করিয়া উন্মত্ত হইতেন এবং অবশেষে তাহার বিশ্বাসঘাতকতায় তাহাকে সজীবাবস্থায় গৃহাবদ্ধ করেন। এই স্থানেই তিনি স্বীয় প্রিয়তম মহিষী লুৎফ উন্নেসার সহিত পবিত্র প্রণয় উপভোগ করিয়াছিলেন এবং রাজ্যপ্রাপ্তির পূর্ব হইতেই একে একে সকলপ্রকার বিলাস-বিভ্রম বিসর্জন দিতে আরম্ভ করিয়া, আলিবর্দীর সিংহাসনের পবিত্রতা রক্ষার্থ যত্নশীল হইয়াছিলেন। হীরাঝিলের প্রাসাদকে দেশীয়গণ মনসুরগঞ্জের প্রাসাদ বলিয়া থাকেন। সিরাজ উক্ত প্রাসাদে মসনদ স্থাপন করিয়া দরবারকার্য সমাধা করিতেন। ফলতঃ রাজকার্য হইতে সামান্য আমোদপ্রমোদ পর্যন্ত সিরাজের সমস্ত ব্যাপারই হীরাঝিলের প্রাসাদে সম্পাদিত হইত। সিরাজের সেই সাধের হীরাঝিল এক্ষণে ভাগীরথীর সহিত মিশিয়া গিয়াছে এবং তাহার উপরিস্থ প্রাসাদও কালগর্ভে নিমগ্ন হইয়াছে। দুই-একটি চত্বরের ভিত্তিভূমি গভীর জঙ্গলসমাবৃত হইয়া এখনও তাহার স্থান নির্দেশ করিয়া দিতেছে। আমরা এ স্থলে হীরাঝিলের নির্মাণ হইতে আরম্ভ করিয়া, তাহার সহিত সংসৃষ্ট প্রধান প্রধান ঐতিহাসিক ঘটনার উল্লেখ করিতেছি।

 আলিবর্দী খাঁ ভাগীরথীর পূর্ব তীরের প্রাসাদে বাস করিতেন। মুর্শিদাবাদের যে-স্থানকে সাধারণতঃ নিজামত কেল্লা বলিয়া থাকে, সেই স্থানে বহুদিন নবাবদিগের প্রাসাদ ছিল। সৌন্দর্যপ্রিয় সিরাজ তথা হইতে অন্য কোন স্থানে একটি মনোরম প্রাসাদনির্মাণের কল্পনা করেন। ভাগীরথীর পশ্চিম তীরে বর্তমান জাফরাগঞ্জের সম্মুখভাগে তাহার স্থান নির্ণীত হয়। হিন্দু ও মুসলমান-গৌরবের সমাধিস্থল গৌড়

  ফৈজীর বিবরণ লুৎফ উন্নেসা নামক প্রবন্ধে দ্রষ্টব্য