পাতা:মুর্শিদাবাদ কাহিনী.djvu/১৩৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
পলাশী
১২৭

সমগ্র বঙ্গরাজ্য প্লাবিত হইয়া আসমুদ্রহিমালয় সমগ্র ভারতবর্ষ ভাসিতে থাকে। পলাশীপ্রান্তরে যে কেবল মুসলমান রাজলক্ষী মূচ্ছিতা হইয়া পড়িয়াছিলেন, এমন নহে; ভারতে তৎকালে আবার যে-হিন্দু রাজরাজেশ্বরী মূর্তির অক্ষুট ছায়া ধীরে ধীরে বিকাশ পাইতেছিল, তাহাও অবশেষে প্রকৃত ছায়াতেই পর্যবসিত হইয়া যায়! ভারতে ব্রিটিশ ক্ষমতা সুদৃঢ় হওয়ায়, মহারাষ্ট্রীয় শক্তি চূর্ণ-বিচূর্ণ হইয়া পড়ে। অন্যান্য ইউরোপীয়গণও ভারতে প্রাধান্য লাভের যে আশায় উফুল্ল হইতেছিল, পলাশীপ্রান্তরে সে আশাও বিকলাঙ্গী হইয়া দীর্ঘনিঃশ্বাস পরিত্যাগ করিতে করিতে ভারত হইতে চিরবিদায় লইতে বাধ্য হয়। পলাশী হইতেই প্রাচ্য জগতে ইংলণ্ডের ক্ষমতা সর্বশ্রেষ্ঠ হইয়া উঠে, সঙ্গে সঙ্গে পাশ্চাত্ত্য জগতেও তাহার ক্ষমতা বৃদ্ধি পাইয়াছে। পলাশীই উত্তমাশা অন্তরীপ, মরিশাস ও মিসরের বিজয় ও সেই সেই স্থানে উপনিবেশ সংস্থাপনের কারণ। পলাশীর জন্যই সমস্ত পৃথিবীতে ইংলণ্ডের বাণিজ্যস্রোত প্রবাহিত হইয়াছে; তাই নীলসাগরের উত্তাল তরঙ্গরাশি ভেদ করিয়া ব্রিটিশ অর্ণবপোত সদর্পে দেশ-বিদেশে গতায়াত করিতেছে। পলাশীই ইংলণ্ড ও তাহার উপনিবেশসমূহের শিল্পকার্যের মহোন্নতি সংসাধিত করিয়াছে। ইংলণ্ডের মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় ভিন্ন ভিন্ন বিভাগের কার্যে নিযুক্ত হইয়া, আপনাদিগের প্রতিভা ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয়ের সঙ্গে সঙ্গে অগাধ সম্পত্তির অধীশ্বর হইয়া মনে মনে পলাশীকে ধন্যবাদ দিতেছেন! ইংলণ্ডের সম্রান্ত বংশীয়গণ শাসনকর্তার পদে প্রতিষ্ঠিত হইয়া নিজ নিজ রাজনৈতিক জ্ঞানের পরিচয় প্রদান করিতেছেন এবং সমস্ত ব্রিটনসন্তানের হৃদয়ে এক অভূতপূর্ব গৌরব সমুদিত হইয়া তাহাদিগকে সমগ্র বসুন্ধরার শ্রেষ্ঠজাতি বলিয়া প্রতিপন্ন করিবার প্রয়াস পাইতেছে। পলাশীই ব্রিটিশ জাতির মনে আমেরিকার স্বাতন্ত্র অবলম্বনের সান্ত্বনা দিয়াছে, এবং তাহার প্রতি অন্যান্য ইউরোপীয় জাতিসমূহের অসূয়াদৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছে।

 আর আমাদের—আমাদের অধিক কথা তুলিবার প্রয়োজন নাই। তবে শত শত বৎসর মুসলমানের পদানত থাকিয়া, সুশাসনের ছায়া যে-জাতির মন হইতে চিরকালের জন্য অন্তহিত হইয়াছিল, পলাশী সে জাতিকে যে যথেষ্ট সান্ত্বনা প্রদান করিয়াছে ইহা কে অস্বীকার করিবে? যে দেশে প্রায়ই বিচারবিভ্রাট ঘটিত, সে দেশে এখন যে রাজার বিরুদ্ধেও বিচার প্রার্থনা করা হয়, ইহা এই হতভাগ্য জাতির পক্ষে কম সান্ত্বনার বিষয় নহে। যে-জ্ঞান বিজ্ঞানে সমগ্র ইউরোপ উন্নতির উচ্চ শিখরে আরোহণ করিয়াছে, পলাশী সেই জ্ঞান-বিজ্ঞানের ছায়া ভারতবর্ষে আনিয়া দিয়াছে। পলাশী যেমন এক দিকে ভারতের দর্শন, ভারতের সাহিত্য, ইউরোপে লইয়া গিয়াছে, সেইরূপ ইউরোপ হইতে পাশ্চাত্ত্য জ্ঞানের আলোেকও আনয়ন করিয়াছে। যে-দেশের অধিবাসিগণ সাধারণতন্ত্রের ও রাজনীতির পরিচয় বহুদিন হইতে জানিত না, পলাশী সেই ইউরোপীয় শাসন-নীতির শান্তিময় হায়াতে সে দেশকে ‘আবৃত করিয়া ফেলিয়াছে।