পাতা:মুর্শিদাবাদ কাহিনী.djvu/১৫২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
১৪৬
মুর্শিদাবাদ-কাহিনী

মুর্শিদাবাদ-কাহিনী ছায়া ঘনীভূত হইতে লাগিল। নবাবের মৃত্যুর অব্যবহিত পরে, তাহার আত্মীয়-স্বজন ও অনুচরবর্গ সমবেত হইয়া, তাহার মৃতদেহ পবিত্ৰীকৃত করার পর, বদ্বারা আচ্ছাদিত করিয়া, রাত্রির অন্ধকার থাকিতে থাকিতে খোশ্‌বাগের সমাধিকাননে তাহার মাতার পদতলে আনিয়া উপস্থিত করে। পরে তথা হইতে যথাস্থানে সমাহিত করা হয়।[১]

 আলিবর্দীর সমাধির অব্যবহিত পূর্বভাগে তাহার প্রিয়তম দৌহিত্র বাঙ্গালীর সুপরিচিত, নবাব সিরাজউদ্দৌলা শায়িত রহিয়াছেন। তাহার বর্তমান সমাধি একরূপ মাটির সহিত মিশিয়াই আছে। তাহার উপর কোন প্রস্তরখণ্ড নাই, কেবল বিলাতী মৃত্তিকা দ্বারা তাহা লেপিত হইয়াছে। সিরাজের শোচনীয় মৃত্যুর কথা বিশেষ করিয়া বলিবার প্রয়োজন নাই; কারণ বঙ্গবাসীমাত্রেই তাহা সবিশেষ অবগত আছেন। তথাপি সে সম্বন্ধে দুই চারিটি কথা বলা যাইতেছে।

 পলাশী যুদ্ধে পরাজিত হইয়া সিরাজ, বেগম লুৎফ উন্নেসার সহিত মুর্শিদাবাদ হইতে পলায়ন করেন এবং রাজমহলের নিকট ধৃত হইয়া পুনরায় মুর্শিদাবাদে আনীত হন। তাহার পর হিজরী ১১৭০ অব্দের ১৫ই শওয়াল (১৭৫৭ খ্রীঃ অব্দের ৩রা জুলাই) তাহার শোচনীয় হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। আমরা মুতাক্ষরীন হইতে তাহার সংক্ষিপ্ত বিবরণ প্রদান করিতেছি।[২] মুতাক্ষরীনকার বলেন যে, যৎকালে সিরাজউদ্দৌল৷ মুর্শিদাবাদে আনীত হন, তৎকালে মীরজাফর সিদ্ধিপানে বিভোর হইয়া মধ্যাহ্ন নিদ্রায় অভিভূত ছিলেন। তাহার পুত্র মীরণ সিরাজউদ্দৌলার উপস্থিতির সংবাদশ্রবণমাত্র জাফরাগঞ্জের বাটীতে তাহাকে বন্দী করিয়া, একে একে অনুচরবর্গের নিকট হতভাগ্যের জীবননাশের প্রস্তাব করে, কিন্তু কেহই তাহাতে সম্মত হইতে ইচ্ছা করিল না।

 অবশেষে মহম্মদী বেগ নামে এক ব্যক্তি এই ভীষণ কাণ্ড সম্পাদনের জন্য স্বীকৃত হইল। এই মহম্মদী বেগ সিরাজউদ্দৌলার পিতা ও মাতামহীর অন্নে প্রতিপালিত হয়। আলিবর্দীর বেগম একটি অনাথকুমারীর সহিত তাহার বিবাহও প্রদান করেন। মহম্মদী বেগ সে-সমস্ত বিস্মৃত হইয়া, সিরাজের হত্যাসম্পাদনে প্রবৃত্ত হইল। পাষণ্ড অহস্তে সিরাজের কক্ষে প্রবেশ করিলে, তিনি বুঝিতে পারিলেন যে, তাহার জীবনবায়ুর অবসান হইতে আর বিলম্ব নাই। তখন তিনি অবনতভাবে ঈশ্বরের অনুগ্রহ প্রার্থনা করিয়া, তাঁহারা অতীত কার্যের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করিলেন। অবশেষে ঘাতকের প্রতি দৃষ্টিনিক্ষেপ করিয়া ঋলিতকণ্ঠে বলিতে লাগিলেণ—"তাহায় কি আমাকে রাজ্যের কোন নির্জন প্রান্তে বাস করিয়া যৎসামান্য জীবিকায় সময় অতিবাহিত

  1. Mutaqherin, Vol I, p. 683.
  2. মুতাক্ষরীনে লিখিত আছে যে, মীরণ মীরজাফরের অজ্ঞাতে সিরাজকে নিহত করিতে আদেশ দেন। কিন্তু রিয়াজুস সালাতীনে লিখিত আছে যে, জগৎশেঠ ও ইংরেজসর্দার সিরাজের হত্যার জন্য মীরজাফরকে উত্তেজিত করিয়াছিলেন। (Riyaz-us-salatin, p. 313.)।