পাতা:মুর্শিদাবাদ কাহিনী.djvu/৩৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
রোশনীবাগ
২৭

শব্দে অবিরত ফোয়ারাগুলি সলিলবৃষ্টি করিতে থাকিত, সলিলভরে পরিপূর্ণ পুষ্করিণী, চৌবাচ্চা, লহরগুলি ঈষৎ সমীরস্পর্শে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তরঙ্গ তুলিয়া নৃত্য করিয়া উঠিত, তাহাদের সঙ্গে সঙ্গে বিহঙ্গমগণের কণ্ঠধ্বনির সহিত গায়িকাগণের মধুর কণ্ঠ মিশ্রিত হইয়া দিগন্তহৃদয়ে মধুর ধারা ঢালিয়া দিত। যদি স্বর্গের পরীগণ বাস্তবিকই পৃথিবীতে ভ্রমণ করিতে আসে, তাহা হইলে ফর্হাবাগের ন্যায় উদ্যানে তাহাদের আগমন বড় বিচিত্র নহে। মধ্যে মধ্যে নবাব স্বীয় অন্তঃপুরবাসিনীদিগের মনোরঞ্জনের জন্য এই সুখকাননে সমবেত হইয়া, নানাবিধ পবিত্র আমোদপ্রমোদ উপভোগ করিতেন। বাস্তবিকই ফর্হাবাগে তিনি প্রকৃত সুখের আস্বাদ পাইতেন। এই সমস্ত আমোদপ্রমোদ ব্যতীত তিনি আর একটি প্রশংসনীয় আমোদ উপভোগ করিতেন। সুজা প্রতি বৎসর যাবতীয় বিদ্বান ও গুণদিগকে নিমন্ত্রণ করিয়া সকলকে সমাদরের সহিত ফৰ্হাবাগে লইয়া যাইতেন, এবং তাহাদিগকে পরিতৃপ্তির সহিত ভোজন করাইতেন।[১] নবাব সুজা উদ্দীন বিলাসী হইয়াও যে গুণের মর্যাদা করিতেন, ইহা হইতে তাহার পরিচয় পাওয়া যায়।

 সুজা উদ্দীনের সাধের ফর্হাবাগ এক্ষণে হতশ্রী হইয়া ধূ ধূ করিতেছে। সে-সমস্ত শ্রেণীবদ্ধ সুন্দর বৃক্ষরাজির চিহ্নমাত্রও নাই। মধ্যস্থলে একটি বৃহৎ পুষ্করিণী শুষ্ক অবস্থায় রহিয়াছে। অল্পদিন হইল, ভাগীরথী মস্‌জেদটিকে নিজ গর্ভে আশ্রয়দান করিয়াছেন। লহর চৌবাচ্চা এ-সকলের কোন নিদর্শন দেখা যায় না, মধ্যে মধ্যে অট্টালিকার ভিত্তির ভগ্নাবশেষমাত্র দেখিতে পাওয়া যায়। দক্ষিণ দিকের একটি তোরণদ্বারের এবং উত্তরদিগের প্রাচীরের কতকটা ভগ্নাবশেষ আজিও বর্তমান আছে। ফর্হাবাগের মধ্যে দুই-এক ঘর কৃষক বাস করিতেছে; তাহারা উদ্যানের ভূমি কর্ষণ করিয়া, তাহাতে সর্ষপাদি শস্য বপন করিয়া থাকে। স্থানটিকে আজিও ফর্হাবাগ বলে, নতুবা লোকে অনুসন্ধান করিয়াও সুজা উদ্দীনের প্রমোদকাননের স্থান নির্দেশ করিতে পারিত না।

 সুজা উদ্দীন হিঃ ১১৩৯ অব্দে মুর্শিদাবাদের সিংহাসনে আরোহণ করিয়া, ১২৫১ অব্দে পরলোকগমন করেন। রোশনীবাগের ছায়াতলে তিনি বিশ্রামলাভ করিতেছেন। রিয়াজ প্রভৃতি গ্রন্থে লিখিত আছে যে, তাঁহাকে কেল্লার সম্মুখে ডাহাপাড়ার মস্‌জেদভবনে সমাহিত করা হয়। এই মস্‌জেদ তাঁহার নিজ-নির্মিত কিনা বলা যায় না। রোশনীবাগে যে-মস্‌জেদটি বিদ্যমান আছে, তাহাতে হিঃ ১১৫৬ অব্দ লিখিত আছে এবং লোকমুখে শুনিতে পাওয়া যায় যে, নবাব আলিবর্দী খাঁ মহাবৎজঙ্গ উক্ত মস্‌জেদ নির্মাণ করিয়াছিলেন। সুজা উদ্দীন হইতে তাঁহার যাবতীয় উন্নতির সূচনা হওয়ায়, আলিবর্দী স্বীয় পূর্ব-প্রভুর পরকালের কল্যাণোদ্দেশে তাঁহার সমাধিভবনে উক্ত মস্‌জেদ নির্মাণ করিয়া থাকিবেন। রোশনীবাগের বর্তমান

  1. Riyaz-us-salatin, p. 307.