পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৮৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

87 রবীন্দ্র-রচনাবলী খবর পাইয়াছি। বাবাকে বলিলাম। আমি কিছুদিনের জন্য আমাদের বারাকপুরের বাগানে যাইব । শুনিয়া তিনি ভারি খুশি হইয়া রাজি হইয়াছেন। তাই বাগানে চলিয়াছি ; ইচ্ছা হইতেছে, আর ফিরিব না। যদি সাহস থাকিত। তবে গঙ্গার জলে ডুবিয়া মরিতাম।” বলিতে বলিতে বেণু কাদিয়া ফেলিল। হরলালের বুকে যেন চুরি বিধিতে লাগিল। একজন অপরিচিত স্ত্রীলোক আসিয়া বেণুর মার ঘর, মার খাট, মার স্থান অধিকার করিয়া লইলে, বেণুর স্নেহস্মৃতিজড়িত বাড়ি যে বেণুর পক্ষে কিরকম কণ্টকময় হইয়া উঠিবে তাহা হরলাল সমন্ত হৃদয় দিয়া বুঝিতে পারিল । মনে মনে ভাবিল, পৃথিবীতে গরিব হইয়া না জমিলেও দুঃখের এবং অপমানের অন্ত নাই। বেণুকে কী বলিয়া যে সান্তনা দিবে তাহা কিছুই ভাবিয়া না পাইয়া বেণুর হাতখানা নিজের হাতে লাইল । লইবামাত্র একটা তর্ক তাহার মনে উদয় হইল । সে ভাবিল, এমন একটা বেদনার সময় বেণু কী করিয়া এত সাজ করিতে পারিল । হরলাল তাহার আংটির দিকে চোখ রাখিয়াছে দেখিয়া বেণু যেন তাহার মনের প্রশ্নটা আঁচিয়া লাইল । সে বলিল, “এই আংটিগুলি আমার মায়ের ।” শুনিয়া হরলাল বহু কষ্টে চোখের জল সামলাইয়া লইল । কিছুক্ষণ পরে কহিল, “বেণু, খাইয়া আসিয়াছ ?” বেণু কহিল, “হী- আপনার খাওয়া হয় নাই ?” হরলাল কহিল, “টাকাগুলি গনিয়া আয়রন-চেস্টে না তুলিয়া ঘর হইতে বাহির হইতে পারিব না।” বেণু কহিল, “আপনি খাইয়া আসুন, আপনার সঙ্গে অনেক কথা আছে। আমি ঘরে রহিলাম ; মা আপনার খাবার লইয়া বসিয়া আছেন ।” হরলাল একটু ইতন্তত করিয়া কহিল, “আমি চট করিয়া খাইয়া আসিতেছি।” হরলাল তাড়াতাড়ি খাওয়া সারিয়া মাকে লইয়া ঘরে প্রবেশ করিল। বেণু তাহাকে প্ৰণাম করিল, তিনি বেণুর চিবুকের স্পর্শ লইয়া চুম্বন করিলেন । হরলালের কাছে সমস্ত খবর পাইয়া তাহার বুক যেন ফাটিয়া যাইতেছিল। নিজের সমস্ত স্নেহ দিয়াও বেণুর অভাব তিনি পূরণ করিতে পরিবেন না। এই তাহার দুঃখ । চারি দিকে ছড়ানো টাকার মধ্যে তিনজনে বসিয়া বেণুর ছেলেবেলাকার গল্প হইতে লাগিল । মাস্টারমশায়ের সঙ্গে জড়িত তাহার কত দিনের কত ঘটনা । তাহার মাঝে মাঝে সেই অসংযতস্নেহশালিনী মার কথাও আসিয়া পড়িতে লাগিল । এমনি করিয়া রাত অনেক হইয়া গেল। হঠাৎ একসময় ঘড়ি খুলিয়া বেণু কহিল, “আর নয়, দেরি করিলে গাড়ি ফেল করিব।” হরলালের মা কহিলেন, “বাবা, আজ রাত্রে এইখানেই থাকো-না, কাল সকালে হরলালের সঙ্গে একসঙ্গেই বাহির হইবে ।” বেণু মিনতি করিয়া কহিল, “না মা, এ অনুরোধ করিবেন না, আজ রাত্রে যে করিয়া হউক আমাকে যাইতেই হইবে ।” হরলালকে কহিল, “মাস্টারমশায়, এই আংটি-ঘড়িগুলা বাগানে লইয়া যাওয়া নিরাপদ নয় । আপনার কাছেই রাখিয়া যাই, ফিরিয়া আসিয়া লইয়া যাইব । আপনার দরোয়ানকে বলিয়া দিন, আমার গাড়ি হইতে চামড়ার হ্যান্ডব্যাগটা আনিয়া দিক । সেইটের মধ্যে এগুলা রাখিয়া দিই।” আপিসের দরোয়ান গাড়ি হইতে ব্যাগ লইয়া আসিল । বেণু তাহার চেন ঘড়ি আংটি বোতাম সমস্ত প্রভাগের মধ্যে পৃদিয়া দিল। সতর্ক হরলাল সেই বাগটি গীয়া অঞ্চই আচরণ সেফের মধ্যে বেণু হরলালের মারা পায়ের ধূলা লইল । তিনি রুদ্ধকণ্ঠে আশীর্বাদ করিলেন, “মা জগদম্বা তোমার মা হইয়া তোমাকে রক্ষা করুন ।” তাহার পরে বেণু হরলালের পাদস্পর্শ করিয়া প্ৰণাম করিল। আর-কোনোদিন সে হরলালকে এমন