পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫২১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Qの8 রবীন্দ্র-রচনাবলী দেখিয়া কতবার তাহার মন অত্যন্ত আকৃষ্ট হইয়াছে, কিন্তু সে আপনার দারিদ্র্যের সংকোচে কোনোদিন ইহার নিকটেও আসে নাই। যদি সে সমকক্ষ লোক হইত, যদি বন্ধুর মতো ইহার কাছে আসিবার অধিকার তাহার পক্ষে স্বাভাবিক হইত, তবে সে কত খুশিই হইত- কিন্তু পরস্পর অত্যন্ত কাছে থাকিলেও মাঝখানে অপার ব্যবধান লঙ্ঘন করিবার উপায় ছিল না । সিঁড়ি দিয়া যখন শৈলেন উঠিত বা নামিতি তখন তাহার শৌখিন চাদরের সুগন্ধ কালীপদার অন্ধকার ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিতে- তখন সে পড়া ছাড়িয়া একবার এই হাস্যপ্ৰফুল্ল চিন্তারেখাহীন তরুণ মুখের দিকে না তাকাইয়া থাকিতে পারিত না । সেই মুহুর্তে কেবল ক্ষণকালের জন্য তাহার সেই স্যাতসেঁতে কোণের ঘরে দূর সৌন্দর্যলোকের ঐশ্বৰ্য-বিচক্ষুরিত রশ্মিচ্ছটাি আসিয়া পড়িত । তাহার পরে সেই শৈলেনের নির্দয় তারুণ্য তাহার কাছে কিরূপ সাংঘাতিক হইয়া উঠিয়ছিল তাহা সকলেরই জানা আছে । আজ শৈলেন যখন ফলের পাত্ৰ বিছানায় তাহার সম্মুখে আনিয়া উপস্থিত করিল। তখন দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া ঐ সুন্দর মুখের দিকে কালীপদ আর-একবার তাকাইয়া দেখিল । ক্ষমার কথা সে মুখে কিছুই উচ্চারণ করিল নাআন্তে আন্তে ফল তুলিয়া খাইতে লাগিল- ইহাতেই যাহা বলিবার তাহা বলা হইয়া গেল । কালীপদ প্ৰত্যহ আশ্চৰ্য হইয়া দেখিতে লাগিল, তাহার গ্ৰাম্য পিতা ভবানীচরণের সঙ্গে শৈলেনের খুব ভােব জমিয়া উঠিল । শৈলেন তাহকে ঠাকুরদা বলে, এবং পরস্পরের মধ্যে অবাধে ঠাট্টােতামাশা চলে। তাহদের উভয়পক্ষের হাস্যকৌতুকের প্রধান লক্ষ্য ছিলেন অনুপস্থিত ঠাকরুনেদিদি । এতকাল পরে এই পরিহাসের দক্ষিণবায়ুর হিল্লোলে ভবানীচরণের মনে যেন যৌবনস্মৃতি পুলক সঞ্চার করিতে লাগিল । ঠাকরুনেদিদির স্বহস্তেরচিত আচার আমসত্ব প্রভূতি সমান্তই শৈলেন রোগীর অনবধানতার অবকাশে চুরি করিয়া নিঃশেষে খাইয়া ফেলিয়াছে। এ কথা আজ সে নির্লজভাবে স্বীকার করিল। এই চুরির খবরে কালীপদর মনে বড়ো একটি গভীর আনন্দ হইল। তাহার মায়ের হাতের সামগ্ৰী সে বিশ্বের লোককে ডাকিয়া খাওয়াইতে চায় যদি তাহারা ইহার আদর বোঝে । কালীপদার কাছে আজ। নিজের রোগের শয্যা আনন্দসভা হইয়া উঠিল- এমন সুখ তাহার জীবনে সে অল্পই পাইয়াছে। কেবল ক্ষণে ক্ষণে তাহার মনে হইতে লাগিল, আহা, মা যদি থাকিতেন ! তাহার মা থাকিলে এই কৌতুকপরায়ণ সুন্দর যুবকটিকে যে কত স্নেহ করিতেন সেই কথা সে কল্পনা করিতে লাগিল । তাহদের রুগণকক্ষসভায় কেবল একটা আলোচনার বিষয় ছিল যেটাতে আনন্দপ্রবাহে মাঝে মাঝে বড়ো বাধা দিত । কালীপদর মনে যেন দারিদ্র্যের একটা অভিমান ছিল- কোনো-এক সময়ে তাহদের প্রচুর ঐশ্বৰ্য ছিল এ কথা লইয়া বৃথা গর্ব করিতে তাহার ভারি লজা বোধ হইত। আমরা গরিব, এ কথাটাকে কোনো "কিন্তু দিয়া চাপা দিতে সে মোটেই রাজি ছিল না । ভবানীচরণও যে র্তাহাদের ঐশ্বর্যের দিনের কথা গর্ব করিয়া পাড়িতেন তাহা নহে। কিন্তু সে যে তাহার সুখের দিন ছিল, তখন তাহার যৌবনের দিন ছিল । বিশ্বাসঘাতক সংসারের বীভৎসমূর্তি তখন ধরা পড়ে নাই । বিশেষত শ্যামাচরণের স্ত্রী, তাহার পরামস্নেহশালিনী ভ্ৰাতৃজায়া রমাসুন্দরী, যখন তাহাদের সংসারের গৃহিণী ছিলেন, তখন সেই লক্ষ্মীর ভরা ভাণ্ডারের দ্বারে দাড়াইয়া কী অজস্র আদরই তাহারা লুটিয়াছিলেনসেই অন্তমিত সুখের দিনের স্মৃতির ছটাতেই তো ভবানীচরণের জীবনের সন্ধ্যা সোনায় মণ্ডিত হইয়া আছে । কিন্তু এই সমস্ত সুখম্মতি আলোচনার মাঝখানে ঘুরিয়া ফিরিয়া কেবলই সেই উইল-চুরির কথাটা আসিয়া পড়ে। ভবানীচরণ এই প্রসঙ্গে ভারি উত্তেজিত হইয়া পড়েন। এখনো সে উইল পাওয়া যাইবে এ সম্বন্ধে তাহার মনে লেশমাত্ৰ সন্দেহ নাই- তাহার সতীসাধাৰী মার কথা কখনোই ব্যর্থ হইবে না । এই কথা উঠিয়া পড়িলেই কালীপদ মনে মনে অস্থির হইয়া উঠিত । সে জানিত এটা তাহার পিতার একটা পাগলামিমাত্র । তাহারা মায়ে ছেলেয়। এই পাগলামিকে আপসে প্রশ্ৰয়ও দিয়াছে, কিন্তু শৈলেনের কাছে তাহার পিতার এই দুর্বলতা প্ৰকাশ পায় এ তাহার কিছুতেই ভালো লাগে না । কতবার সে পিতাকে বলিয়াছে, “না। বাবা, ওটা তোমার একটা মিথ্যা সন্দেহ ।” কিন্তু এরাপ তর্কে উলটা ফল হইত। তাহার সন্দেহ যে অমূলক নহে তাহা প্ৰমাণ করিবার জন্য সমন্ত ঘটনা তিনি তন্ন তন্ন করিয়া বিবৃত করিতে থাকিতেন। তখন কালীপদ নানা চেষ্টা করিয়াও কিছুতেই ঠাহকে থামাইতে