পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৩৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চতুরঙ্গ জ্যাঠামশায় আমি পাড়াগী হইতে কলিকাতায় আসিয়া কলেজে প্রবেশ করিলাম। শচীশ তখন বি. এ. ক্লাসে পড়িতেছে। আমাদের বয়স প্রায় সমান হইবে। শচীশকে দেখিলে মনে হয় যেন একটা জ্যোতিষ্ক- তার চোখ জ্বলিতেছে ; তার লম্বা সরু আঙুলগুলি যেন আগুনের শিখা ; তার গায়ের রঙ যেন রঙ নহে, তাহা আভা। শচীশকে যখন দেখিলাম অমনি যেন তার অন্তরাত্মকে দেখিতে পাইলাম ; তাই এক মুহূর্তে তাহাকে ভালোবাসিলাম। কিন্তু আশ্চর্য এই যে, শচীশের সঙ্গে যারা পড়ে তাদের অনেকেরই তার উপরে একটা বিষম বিদ্বেষ। আসল কথা, যাহারা দশের মতে, বিনা কারণে দশের সঙ্গে তাঁহাদের বিরোধ বাধে না। কিন্তু মানুষের ভিতরকার দীপ্যমান সত্যপুরুষটি স্থূলতা ভেদ করিয়া যখন দেখা দেয় তখন অকারণে কেহ বা তাহাকে প্রাণপণে পূজা করে, আবার অকারণে কেহ বা তাহাকে প্রাণপণে অপমান করিয়া থাকে। আমার মেসের ছেলেরা বুঝিয়েছিল, আমি শচীশকে মনে মনে ভক্তি করি। এটাতে সর্বদাই তাহাদের যেন আরামের ব্যাঘাত করিত। তাই আমাকে শুনাইয়া শচীশের সম্বন্ধে কটু কথা বলিতে তাহাদের একদিনও কামাই যাইত না । আমি জানিতাম, চোখে বালি পড়িলে রগড়াইতে গেলেই বাজে বেশি ; কথাগুলো যেখানে কর্কশ সেখানে জবাব না করাই ভালো। কিন্তু, একদিন শচীশের চরিত্রের উপর লক্ষ করিয়া এমন সব কুৎসা উঠিল, আমি চুপ করিয়া থাকিতে পারিলাম না। আমার মুশকিল, আমি শচীশকে জানিতাম না। অপর পক্ষে কেহ বা তার পাড়াপড়শি, কেহ-বা তার কোনো-একটা সম্পর্কে কিছু-একটা । তারা খুব তেজের সঙ্গে বলিল, এ একেবারে খাটি সত্য ; আমি আরো তেজের সঙ্গে বলিলাম, আমি এর সিকি-পয়সা বিশ্বাস করি না। তখন মেসসুদ্ধ সকলে আস্তিন গুটািইয়া বলিয়া উঠিল, তুমি তো ভারি অভদ্র লোক হে! সে রাত্রে বিছানায় শুইয়া আমার কান্না আসিল। পরদিন ক্লাসের একটা ফঁাকে শচীশ যখন গোলদিঘির ছায়ায় ঘাসের উপর আধ-শোওয়া অবস্থায় একটা বই পড়িতেছে আমি বিনা পরিচয়ে তার কাছে আবােল-তাবােল কী যে বকিলাম তার ঠিক নাই। শচীশ বই মুড়িয়া আমার মুখের দিকে কিছুক্ষণ চাহিয়া রহিল। তার চােখ যারা দেখে নাই তারা বুঝিবে না। এই দৃষ্টি যে কী। শচীশ বলিল, যারা নিন্দা করে তারা নিন্দ ভালোবাসে বলিয়াই করে, সত্য ভালোবাসে বলিয়া নয় । দি ইল স্তরে কােনে এটা লৈ যে সন্তান তার প্রমণ করার জন্য ঊষ্ট হরিয়া লাভ . আমি বলিলাম, তবু দেখুন, মিথ্যাবাদীকেশচীশ বাধা দিয়া বলিল, ওরা তো মিথ্যাবাদী নয়। আমাদের পাড়ায় পক্ষাঘাতে একজন কলুর ছেলের গা-হাত কঁপে, সে কাজ করিতে পারে না, শীতের দিনে আমি তাকে একটা দামি কম্বল দিয়াছিলাম। সেইদিন আমার চাকর শিবু রাগে গরগর করিতে করিতে আসিয়া বলিল, বাবু, ও বেটার কঁপুনি-টাপুনি সমস্ত বদমায়েশি - আমার মধ্যে কিছু ভালো আছে। এ কথা যারা উড়াইয়া দেয় তাদের সেই শিবুর দশা। তারা যা বলে তা সত্যই বিশ্বাস করে। আমার ভাগে একটা-কোনাে দামি কম্বল অতিরিক্ত জুটিয়াছিল, রাজ্যসূদ্ধ শিবুর দল নিশ্চয় স্থির করিয়াছে, সেটাতে আমার অধিকার নাই। আমি তা লইয়া তাদের সঙ্গে ঝগড়া করিতে লজা বোধ করি।