পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭০৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিবিধ প্ৰসঙ্গ \9& ) সে থাকে তখন সে সমস্ত স্থান জুড়িয়া থাকে, নয়। সে থাকে না । যখন সে দেখে তাহার অধিকার হ্রাস হইয়া আসিতেছে তখন সে বন্ধুত্বের ক্ষুদ্র স্থানটুকু অধিকার করিয়া থাকিতে চায় না । যে রাজা ছিল সে ফকির হইতে রাজি আছে, কিন্তু করদ জায়গীরদার হইয়া থাকিবে কিরূপে ? হয় রাজত্ব নয় ফকিরী, ইহার মধ্যে তাহার দাড়াইবার স্থান নাই। ইহা ছাড়া আর একটা কথা আছে— প্ৰেম মন্দির ও বন্ধুত্ব বাসস্থান । মন্দির হইতে যখন দেবতা চলিয়া যায়। তখন সে আর বাসস্থানের কাজে লাগিতে পারে না, কিন্তু বাসস্থানে দেবতা প্ৰতিষ্ঠা করা যায় । আত্মসংসর্গ দুঃখের সুর একঘেয়ে কেন ? বলা বাহুল্য, মন যেখানে বৈচিত্র্য দেখে না সেখানে সে নিজের অন্তঃপুরের মধ্যে নিজে বসিয়া থাকে, কৌতুহল উদ্রেক না হইলে সে বাহির হইবার কোনো আবশ্যক দেখে না। যাহা কিছু একঘেয়ে, তাহাই আমাদিগকে আমাদের নিজের কাছে প্রেরণ করে । এই জন্যই একঘেয়ে সুরের মধ্যে একটি করুণ ভাব আছে। যখনি আমরা আমাদের নিজের কাছে থাকি, তখনই আমাদের দুঃখ । আমরা নিজের কাছ হইতে পলাইয়া থাকিতে পারিলেই সুখে থাকি । যখন বাহ্য জগৎ সুন্দর আকার ধারণ করে, তখন আমরা কেন সুখে থাকি ? কারণ, তখন আমাদের মন তাহার নিজের হাত এড়াইয়া বাহিরে সঞ্চরণ করিতে পারে ; আর যখন আমাদের চারিদিকে বাহ্য জগৎ কদৰ্য মূর্তি ধারণ করে, তখন আমাদের মনকে দায়ে পডিয়া নিজের কাছেই ফিরিয়া আসিতে হয় ও আমরা অসুখী হই । এই জন্যই আমাদের অন্তর ও বাহির, আমাদের মন ও জগৎ সম্পূৰ্ণ স্বতন্ত্র পদার্থ হইলেও জগতের উপর আমাদের মনের সুখ এতটা নির্ভর করে যে, জগৎ বেঁকিয়া দাড়াইলেই আমাদের মন কঁদিয়া উঠে । সে নিজের কাছে কোনো মতেই থাকিতে চায় না । সে একটি অভাব মাত্র । সে এই বিশাল জগৎসংসারের মহাক্ষেত্রে প্রতি শব্দ, প্রতি দৃশ্য, প্রতি গন্ধ, প্রতি স্বাদকে শিকার করিয়া বেড়াইতেছে ; যতক্ষণ শিকার করে ততক্ষণ থাকে ভালো, অবশেষে যখন রিক্তহন্তে শ্ৰান্তদেহে গৃহে ফিরিয়া আসে তখনি তাহার দুঃখ । আমরা ভালোবাসিতে চাই, কেননা আমরা আপনাকে চাই না, আর এক জনকে চাই ; আমরা একটা কিছু কাৰ্য করিতে চাই, কেননা আমরা নিজের কাছে থাকিতে চাই না ; আমরা উপাৰ্জন করিতে চাই, কেননা আমাদের পৈতৃক সম্পত্তিই অভাব। আমাদের মনের অর্থ-ভিক্ষার অঞ্জলি, জগতের অর্থভিক্ষামুষ্টি । ভস্মলোচনকে যেমন নিজের মুখ দেখাইয়া বধ করা হইয়াছিল, তেমনি সমস্ত জগৎ যদি একটি বিশাল দৰ্পণ হইত চারি দিকে কেবল আমাদের নিজের মুখ দেখিতে পাইতাম, তাহা হইলে আমরা মরিয়া যাইতাম। তাহা হইলে আমরা কি দেখিতাম ? একটা ক্ষুধা, একটা দুর্ভিক্ষ, একটা প্রার্থনা, একটা রোদন। আমাদের মন গোটকতক ক্ষুধার সমষ্টি মাত্র । জ্ঞানের ক্ষুধা, আসঙ্গের ক্ষুধা, সৌন্দর্যের ক্ষুধা। আমাদের দিকে অনন্ত জ্ঞানের পিপাসা, আর জগতের দিকে অনন্ত রহস্য। আমরা প্ৰাণের সহচর চাই, কিন্তু “লাখে না মিলল। একে” । আমরা সৌন্দৰ্য উপভোগ করিতে চাই, অথচ সৌন্দর্যকে দুই হাতে স্পর্শ করিলেই সে মলিন হইয়া যায়। আমরা কৃষ্ণবৰ্ণ ; সূর্যরশ্মির সমস্ত বৰ্ণধারা পান করিয়া থাকি, তথাপি আমরা কালো। সূর্যরশ্মি পান করিবার আমাদের অনন্ত পিপাসা। এইরূপে অনন্ত জ্ঞানের ক্ষুধা লইয়া যে রহস্যে দন্তস্ফুট করিতে পারিব না। তাহাকেই অনবরত আক্রমণ করা, অনন্ত আসঙ্গের ক্ষুধা লইয়া যে সহচর মিলিবে না। তাহাকেই অবিরত অন্বেষণ করা, অনন্ত সৌন্দর্যের ক্ষুধা লইয়া যে সৌন্দর্য ধরিয়া রাখিতে পারিব না। তাহাকেই চির উপভোগ করিতে চেষ্টা করা, এক কথায়, অনন্ত মন অর্থাৎ সমষ্টিবদ্ধ কতকগুলি অনন্ত ক্ষুধা হইয়া জগতের পশ্চাতে অনন্ত ধাবমান