পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৪৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নীেকাডবি N বাজে না, সুর-বেসুরের মধ্যে সে কোনোপ্রকার পক্ষপাত না করিয়া দিব্য নিশ্চিন্তমনে রাগরাগিণীকে সর্বত্র লঙ্ঘন করিয়া যায় | হেমনলিনী যেই বলে, “ও কী করিতেছেন, ভুল হইল যে-” অমনি অত্যন্ত তাড়াতাড়ি দ্বিতীয় ভুলের দ্বারা প্রথম ভুলটা নিরাকৃত করিয়া দেয়। গভীরপ্রকৃতি অধ্যবসায়ী রমেশ হাল ছাড়িয়া দিবার লোক নহে। রাস্তা-তৈরির স্টীমরোলার যেমন মন্থরগমনে চলিতে থাকে, তাহার তলায় কী যে দলিত পিষ্ট হইতেছে তাহার প্রতি ভুক্ষেপমাত্র করে না, হতভাগা স্বরলিপি এবং হারমোনিয়মের চাবিগুলার উপর দিয়া রমেশ সেইরূপ অনিবাৰ্য অন্ধতার সহিত বার বার যাওয়া-আসা করিতে লাগিল । রমেশের এই মৃঢ়তায় হেমনলিনী হাসে, রমেশও হাসে। রমেশের ভুল করিবার অসাধারণ শক্তিতে হেমনলিনীর অত্যন্ত আমোদ বোধ হয় । ভুল হইতে, বেসুর হইতে, অক্ষমতা হইতে আনন্দ পাইবার শক্তি ভালোবাসারই আছে । শিশু চলিতে আরম্ভ করিয়া বার বার ভুল পা ফেলিতে থাকে, তাহাতেই মাতার স্নেহ উদবেল হইয়া উঠে । বাজনা সম্বন্ধে রমেশ যে অদ্ভুত রকমের অনভিজ্ঞতা প্রকাশ করে, হেমনলিনীর এই এক বড়ো কৌতুক । বমেশ এক-এক বার বলে, “আচ্ছা, আপনি যে এত হাসিতেছেন, আপনি যখন প্রথম বাজাইতে শিখিতেছিলেন তখন ভুল করেন নাই ?” হেমনলিনী বলে, “ভুল নিশ্চয়ই করিতাম, কিন্তু সত্যি বলিতেছি। রমেশবাবু, আপনার সঙ্গে তুলনাই ठूग्न क्रा |" রমেশ ইহাতে দমিত না, হাসিয়া আবার গোড়া হইতে শুরু করিত । অন্নদাবাবু সংগীতের ভালোমন্দ কিছুই বুঝিতেন না, তিনি এক-এক বার গভীর হইয়া কান খাড়া করিয়া দাড়াইয়া কহিতেন, “তাই তো, অন্নদা । না না, প্ৰথমে যেমন শুনিয়াছিলাম, এখন তার চেয়ে অনেকটা অভ্যাস হইয়া আসিয়াছে । আমার তো বোধ হয়, রমেশ যদি লাগিয়া থাকে তাহা হইলে উহার হাত নিতান্ত মন্দ হইবে না । গানবাজনায় আর কিছু নয়, খুব অভ্যাস করা চাই । একবার সারেগামার বোধটা জন্মিয় গেলেই তাহার পরে সমস্ত সহজ হইয়া আসে । এ-সকল কথার উপরে প্রতিবাদ চলে না । সকলকে নিরুত্তর হইয়া শুনিতে হয় । δ প্রায় প্রতিবৎসর শরৎকালে পূজার টিকিট বাহির হইলে হেমনলিনীকে লইয়া অন্নদাবাবু জব্বলপুরে তাহার ভগিনীপতির কর্মস্থানে বেড়াইতে যাইতেন । পরিপাকশক্তির উন্নতিসাধনের জন্য র্তাহার এই সাংবাৎসরিক চেষ্টা । ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি হইয়া আসিল, এবারে পূজার ছুটির আর বড়ো বেশি বিলম্ব নাই । অন্নদাবাবু এখন হইতেই তাহার যাত্রার আয়োজনে ব্যস্ত হইয়াছেন । আসন্ন বিচ্ছেদের সম্ভাবনায় রমেশ আজকাল খুব বেশি করিয়া হারমোনিয়ম শিখিতে প্ৰবৃত্ত হইয়াছে ! একদিন কথায় কথায় হেমনলিনী কহিল, “রমেশবাবু, আমার বোধ হয়, আপনার অন্তত কিছুদিন বায়ুপরিবর্তন দরকার । না বাবা ?” অন্নদাবাবু ভাবিলেন কথাটা সংগত বটে, কারণ ইতিমধ্যে রমেশের উপর দিয়া শোকদুঃখের দুৰ্যোগ গিয়াছে । কহিলেন, “অন্তত কিছুদিনের জন্য কোথাও বেড়াইয়া আসা ভালো ! বুঝিয়াছ রমেশ, পশ্চিমই বল আর যে দেশই বল, আমি দেখিয়াছি, কেবল কিছুদিনের জন্য একটু ফল পাওয়া যায় । প্রথম দিনকতক বেশ ক্ষুধা বাড়ে, বেশ খাওয়া যায়, তাহার পরে যে-কে সেই । সেই পেট ভার হইয়া আসে, বুক জ্বালা করিতে থাকে, যা খাওয়া যায় তা-ই—”