পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৭৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নীেকাডুবি W98(፩ কমলা কহিল, “দিদি, আমার সব কথা তুমি শুনিবে ?” শৈল স্নিগ্ধস্বরে কহিল, “শুনিব না তো কি বোন ?” কমলা । তখন যে তোমাকে কেন বলিতে পারি নাই, তাহা জানি না । তখন আমার কোনো কথা ভাবিয়া দেখিবার সময় ছিল না। হঠাৎ মাথায় এমন বজ্ৰাঘাত হইয়াছিল যে, লজ্জায় তোমার কাছে মুখ দেখাইতে পারিতেছিলাম না। সংসারে আমার মা-বোন কেহ নাই, দিদি, তুমি আমার মা বোন দুইতাই তোমার কাছে সব কথা বলিতেছি, নহিলে আমার যে কথা তাহা কাহারও কাছে বলিবার নয় । কমলা আর শুইয়া থাকিতে পারিল না, উঠিয়া বসিল। শৈলও উঠিয়া তাহার সম্মুখে বসিল । সেই অন্ধকার বিছানার মধ্যে বসিয়া কমলা বিবাহ হইতে আরম্ভ করিয়া তাহার জীবনের কাহিনী বলিতে লাগিল । কমলা যখন বলিল, “বিবাহের পূর্বে বা বিবাহের রাত্রে সে তাহার স্বামীকে দেখে নাই তখন শৈল কহিল, “তোর মতো বোকা মেয়ে তো আমি দেখি নাই । তোর চেয়ে কম বয়সে আমার বিবাহ হইয়াছিল- তুই কি মনে করিস, লজ্জায় আমি আমার বরকে কোনো সুযোগে দেখিয়া লই নাই!” কমলা কহিল, “লজা নয় দিদি ! আমার বিবাহের বয়স প্রায় পার হইয়া গিয়াছিল । এমন সময়ে হঠাৎ যখন আমার বিবাহের কথা স্থির হইয়া গেল, তখন আমার সমস্ত সঙ্গিনীরা আমাকে বড়োই খাপাইতে আরম্ভ করিয়াছিল। অধিক বয়সে বরকে পাইয়া আমি যে সাত রাজার ধন মানিক পাই নাই, ইহাই দেখাইবার জন্য আমি তাহার দিকে দৃকপাতমাত্র করি নাই। এমন-কি, তাহার জন্য কিছুমাত্র আগ্রহ মনের মধ্যেও অনুভব করা আমি নিতান্ত লজ্জার বিষয়, অগৌরবের বিষয় বলিয়া মনে করিয়াছিলাম। আজ তাহারই শোধ দিতেছি।” এই বলিয়া কমলা কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিল। তাহার পরে আরম্ভ করিল, “বিবাহের পর নীেকাডুবি হইয়া আমরা কী করিয়া রক্ষা পাইলাম, সে কথা তো তোমাকে পূর্বেই বলিয়াছি। কিন্তু যখন বলিয়ছিলাম তখনো জানিতাম না যে, মৃত্যু হইতে রক্ষা পাইয়া যাহার হাতে পড়িলাম, র্যাহাকে শৈলজা চমকিয়া উঠিল ; তাড়াতাড়ি কমলার কাছে আসিয়া তাহার গলা ধরিয়া কহিল, “হায় রে পোড়া কপাল- ও, তাই বটে। এতক্ষণে সব কথা বুঝিলাম। এমন সর্বনাশও ঘটে ।” কমলা কহিল, “বল দেখি দিদি, যখন মরিলেই চুকিয়া যাইত তখন বিধাতা এমন বিপদ ঘটাইলেন কেন ?” শৈলজা জিজ্ঞাসা কবিল, “রমেশবাবুও কিছুই জানিতে পারেন নাই ?” কমলা কহিল, “বিবাহের কিছুকাল পরে তিনি একদিন আমাকে সুশীলা বলিয়া ডাকিতেছিলেন, আমি তঁহাকে কহিলাম, ‘আমার নাম কমলা, তবু তোমরা সকলেই আমাকে সুশীলা বলিয়া ডাক কেন ? আমি এখন বুঝিতে পারিতেছি, সেইদিন তাহার ভুল ভাঙিয়ছিল। কিন্তু দিদি, সে-সকল দিনের কথা মনে করিতেও আমার মাথা হেঁট হইয়া যায়।” এই বলিয়া কমলা চুপ করিয়া রহিল। শৈলজা একটু একটু করিয়া কথায় কথায় সমস্ত বৃত্তান্ত আগাগোড়া বাহির করিয়া লইল । সমস্ত কথা শোনা হইলে সে কহিল, “বোন, তোর দুঃখের কপাল, কিন্তু আমি এই কথা ভাবিতেছি, ভাগ্যে তুই রমেশবাবুর হাতে পড়িয়ছিল। যাই বলিস, বেচারা রমেশবাবুর কথা মনে করিলে বড়ো দুঃখ হয়। আজ রাত অনেক হইল, কমল, তুই আজ ঘুমো। কদিন রাত জাগিয়া কাদিয়া মুখ কালি হইয়া গৈছে | এখন কী করিতে হইবে, কাল সব ঠিক করা যাইবে।” রমেশের লিখিত সেই চিঠি কমলার কাছে ছিল। পরদিন সেই চিঠিখানি লইয়া শৈলজা তাহার পিতাকে নিভৃত ঘরে ডাকিয়া পাঠাইল এবং চিঠি তাহার হাতে দিল। খুড়া চশমা চােখে তুলিয়া অত্যন্ত ধীরে ধীরে পাঠ করিলেন ; তাহার পরে চিঠি মুড়িয়া, চশমা খুলিয়া কন্যাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তাই তোঁ, এখন কী কর্তব্য ?” শৈল কহিল, “বাবা, উমির কয়দিন হইতে সদিকশিা করিয়াছে, একবার নলিনাক্ষ ডাক্তারকে ডাকিয়া