পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৮১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা 886 সেখানে কেবলই ঠেলাঠেলি হাতাহাতি চলছে- ভারতবর্ষের এই উত্তরটা মানবসমাজে এখনো সফলতার জন্যে প্রতীক্ষা করে আছে- আমরা একে ক্ষুদ্র সম্প্রদায়ের অন্ধতাবশত উড়িয়ে দিলেই যে এ উড়ে যাবে তা মনেও করবেন না। আমরা ছােটাে ছােটাে সম্প্রদায়েরা জলবিম্বের মতো সমুদ্রে মিশিয়ে যাব, কিন্তু ভারতবর্ষের সহজ প্রতিভা হতে এই যে একটা প্রকাণ্ড মীমাংসা উদ্ভূত হয়েছে পৃথিবীর মধ্যে যতক্ষণ পর্যন্ত এর কাজ না হবে ততক্ষণ এ স্থির দাঁড়িয়ে থাকবে। সুচরিতা সংকুচিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “আপনি রাগ করবেন না, কিন্তু সত্যি করে বলুন, এ-সমস্ত কথা কি আপনি গীেরমোহনবাবুর প্রতিধ্বনির মতো বলছেন, না। এ আপনি সম্পূর্ণ বিশ্বাস করেছেন ?” বিনয় হাসিয়া কহিল, “আপনাকে সত্য করেই বলছি, গোরার মতো আমার বিশ্বাসের জোর নেই। জাতিভেদের আবর্জনা ও সমাজের বিকারগুলো যখন দেখতে পাই তখন আমি অনেক সময়েই সন্দেহ প্রকাশ করে থাকি- কিন্তু গোরা বলে, বড়ো জিনিসকে ছোটাে করে দেখলেই সন্দেহ জন্মে- গাছের ভাঙা ডাল ও শুকনো পাতাকেই গাছের চরম প্রকৃতি বলে দেখা বুদ্ধির অসহিষ্ণুতা— ভাঙা ডালকে প্রশংসা করতে বলি নে, কিন্তু বনস্পতিকে সমগ্র করে দেখো এবং তার তাৎপর্য বুঝতে চেষ্টা করো।” সুচরিতা । গাছের শুকনো পাতাটা নাহয় নাই। ধরা গেল, কিন্তু গাছের ফলটা তো দেখতে হবে। বিনয় । যাকে জাতিভেদের ফল বলছেন সেটা অবস্থার ফল, শুধু জাতিভেদের নয়। নড়া দাঁত দিয়ে চিবোতে গেলে ব্যথা লাগে, সেটা দাতের অপরাধ নয়, নড়া দাতেরই অপরাধ। নানা কারণে আমাদের মধ্যে বিকার ও দুর্বলতা ঘটেছে বলেই ভারতবর্ষের আইডিয়াকে আমরা সফল না করে বিকৃত করছি— সে বিকার আইডিয়ার মূলগত নয়। আমাদের ভিতর প্রাণ ও স্বাস্থ্যের প্রাচুর্য ঘটলেই সমস্ত ঠিক হয়ে যাবে। গোরা সেইজন্যে বারবার বলে যে, মাথা ধরে বলে মাথাটাকে উড়িয়ে দিলে চলবে না- সুস্থ হও, সবল হও । সুচরিতা । আচ্ছা, তা হলে আপনি ব্ৰাহ্মণ জাতকে নরদেবতা বলে মানতে বলেন ? আপনি সত্যি বিশ্বাস করেন ব্রাহ্মণের পায়ের ধূলোয় মানুষ পবিত্র হয় ? বিনয় । পৃথিবীতে অনেক সম্মােনই তো আমাদের নিজের সৃষ্টি । রাজাকে যতদিন যে কারণেই হােক দরকার থাকে। ততদিন মানুষ তাকে অসামান্য বলে প্রচার করে। কিন্তু রাজা তো সত্যি অসামান্য নয়। অথচ নিজের সামান্যতর বাধা ভেদ করে তাকে অসামান্য হয়ে উঠতে হবে, নইলে সে রাজত্ব করতে পারবেই না। আমরা রাজার কাছে থেকে উপযুক্তরূপ রাজত্ব পাবার জন্যে তাকে অসামান্য করে গড়ে তুলি- আমাদের সেই সম্মানের দাবি রাজাকে রক্ষা করতে হয়, তাকে অসামান্য হতে হয়। মানুষের সকল সম্বন্ধের মধ্যেই এই কৃত্রিমতা আছে। এমন-কি, বাপ-মাির যে আদর্শ আমরা সকলে মিলে খাড়া করে রেখেছি তাতে করেই সমাজে বাপ-মাকে বিশেষভাবে বাপ-মা করে রেখেছে, কেবলমাত্র স্বাভাবিক স্নেহে নয়। একান্নবর্তী পরিবারে বড়ো ভাই ছোটাে ভাইয়ের জন্য অনেক সহ্য ও অনেক ত্যাগ করে- কেন করে ? আমাদের সমাজে দাদাকে বিশেষভাবে দাদা করে তুলেছে, অন্য সমাজে তা করে নি। ব্ৰাহ্মণকেও যদি যথার্থভাবে ব্ৰাহ্মণ করে গড়ে তুলতে পারি তা হলে সে কি সমাজের পক্ষে সামান্য লাভ ! আমরা নরদেবতা চাই- আমরা নরদেবতাকে যদি যথার্থই সমস্ত অন্তরের সঙ্গে বুদ্ধিপূর্বক চাই তা হলে নরদেবতাকে পাব। আর যদি মূঢ়ের মতে চাই তা হলে যে-সমস্ত অপদেবতা সকল রকম দুষ্কর্ম করে থাকে এবং আমাদের মাথার উপরে পায়ের ধুলো দেওয়া যাদের জীবিকার উপায় তাদের দল বাড়িয়ে ধরণীর ভর বৃদ্ধি করা হবে। সুচরিতা। আপনার সেই নরদেবতা কি কোথাও আছে ? বিনয় । বীজের মধ্যে যেমন গাছ আছে তেমনি আছে, ভারতবর্ষের আন্তরিক অভিপ্ৰায় এবং শ্ৰীয়োজনের মধ্যে আছে। অন্য দেশ ওয়েলিংটনের মতো সেনাপতি, নিউটনের মতো বৈজ্ঞানিক, মথটাইন্ডের মতো লক্ষপতি চায়, আমাদের দেশ ব্ৰাহ্মণকে চায়। ব্ৰাহ্মণ, যার ভয় নেই, লোভকে যে